সামনের জানুয়ারিতে অবসর নেওয়ার কথা এক শিক্ষক-চিকিৎসকের। উত্তেজনায় প্রায় ফুটছেন তিনি। স্বাস্থ্য ভবনে গিয়ে যাঁকে সামনে পাচ্ছেন, তাঁকেই জিজ্ঞাসা করছেন, ‘‘নতুন নির্দেশিকাটা ঠিক কবে বেরোবে? আমার ফাঁড়াটা কাটবে তো?’’
এই ‘ফাঁড়া কাটা’র প্রশ্নটাই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
শিক্ষক-চিকিৎসকদের অবসরের বয়স বাড়াচ্ছে রাজ্য সরকার। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে স্বাস্থ্যসচিব রাজেন্দ্র শুক্ল গত সপ্তাহে সে কথা ঘোষণা করার পরেই রীতিমতো শোরগোল পড়ে গিয়েছে চিকিৎসক মহলে। ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন অনেকেই। যাঁদের মাস কয়েকের মধ্যেই অবসর নেওয়ার কথা, তাঁরা অনেকেই খোঁজ নিচ্ছেন, সরকারের এই সিদ্ধাম্ত ঠিক কবে থেকে কার্যকর হবে। তাঁদের প্রশ্ন, রাজ্যে চিকিৎসকের আকাল বলেই কি এ বার ‘আমৃত্যু’ তাঁদের কাজ করে যেতে হবে? কেন এই ধরনের কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এক বারও তাঁদের মতামত জানতে চাওয়া হবে না? এমনিতেই অবসরের বয়স বেড়ে ৬৫ হওয়ার পরে কয়েক জন
চিকিৎসক তা না মেনে কাজ ছেড়েছিলেন। সে নিয়ে এখনও একাধিক মামলা চলছে। এই পরিস্থিতিতে অবসরের বয়স ফের বাড়ার পরে সরকারি চিকিৎসক মহলের একাংশের প্রশ্ন, তাঁরা কি তা হলে কোনও দিনই অবসর জীবনের স্বাদ পাবেন না?
ইতিমধ্যেই কয়েক জন চিকিৎসক মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চিঠি লিখেছেন। তাঁদের বক্তব্য, যাঁরা ৬৫-র পরেও কাজ করে যেতে চান, তাঁরা থাকুন। কিন্তু যাঁরা চান না, তাঁদের যেন না চাওয়ার, ছেড়ে যাওয়ার স্বাধীনতাটা থাকে। এই না চাওয়ার পিছনে শারীরিক সক্ষমতার প্রশ্নও তুলেছেন তাঁদের অনেকে।
শিক্ষক-চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁদের যে শুধু ক্লাস নিতে হয় তা–ই নয়, চিকিৎসা করতে হয়, অস্ত্রোপচার করতে হয়। নির্দিষ্ট একটা বয়সের পর সেটা কি ধরে-বেঁধে করানো সম্ভব? এক
কার্ডিয়াক সার্জনের কথায়, ‘‘যেখানে রোগীর জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত, সেখানে কাঁপা হাত নিয়ে অস্ত্রোপচার করবেন ডাক্তার। সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে এমন করা কি ঠিক হচ্ছে?’’ একই কথা বলেছেন এক প্রবীণ চোখের ডাক্তারও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে ক্ষীণ দৃষ্টি, কাঁপা হাত নিয়ে চোখের জটিল অস্ত্রোপচার করতে হবে ভেবেই তো ঘামছি আমি। সব কিছুরই তো একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। অস্ত্রোপচারে একটা এ দিক-ও দিক হলে তখন তো রোগীর বাড়ির লোকেরা আমাদের ধরবেন!’’
কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রবীণ শিক্ষক-চিকিৎসক বলছেন, ‘‘সরকারি চাকরির কোনও সুযোগ-সুবিধে বাড়ছে না। উল্টে কাজের চাপ উত্তরোত্তর বাড়ছে। রোগীর বাড়ির লোকজন বেশির ভাগ সময়েই মারমুখী হয়ে থাকছেন। এই পরিস্থিতিতে আমাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা বাড়িয়ে নাম কিনবে সরকার। এটা তো চলতে পারে না।’’ বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের এক শিক্ষক-চিকিৎসকের আক্ষেপ, ‘‘আমার মেয়ে বিদেশে থাকে। এক মাসের জন্য মেয়ের কাছে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিলাম। পাইনি। সামনেই অবসর নেওয়ার কথা। ভেবেছিলাম, তার পরে যাব। এখন তো দেখছি, এমন একটা খাঁচায় বন্দি হয়ে আছি, যার দরজা জীবদ্দশায় খুলবে না।’’
শিক্ষক-চিকিৎসকদের একটা বড় অংশের আপত্তি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে সরকারপন্থী এবং সরকারপন্থী নন— চিকিৎসকদের ইউনিয়নের এই দুই গোষ্ঠীর অবস্থানই এক রকম। তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক সংগঠন প্রোগ্রেসিভ ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন-এর তরফে সাক্ষীগোপাল সাহা এবং সিপিএমপন্থী চিকিৎসক সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টরস-এর সম্পাদক সত্যজিৎ চক্রবর্তী দু’জনেই জানিয়েছেন, এ নিয়ে তাঁদের কাছেও প্রচুর আপত্তি আসছে। সত্যজিৎবাবু আপত্তির পাশাপাশি প্রশ্ন তুলেছেন, হাসপাতালে ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে কেন এমন কালঘাম ছুটছে, সেই দিকটা সরকার কেন ভেবে দেখছে না? তাঁর কথায়, ‘‘স্নাতকোত্তর স্তরে পঠনপাঠনে হাজারো নিয়মকানুন, হেলথ সার্ভিস থেকে মেডিক্যাল এডুকেশন সার্ভিসে যাওয়ার পথ বন্ধ, বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেলে যাওয়া যাবে না, নতুন ডাক্তাররা তাই আগ্রহী হচ্ছেন না সরকারি চাকরিতে। সেটা সরকারের ব্যর্থতা। সেই ব্যর্থতার দিকটিতে নজর না দিয়ে বয়স্ক চিকিৎসকদের পায়ে বেড়ি পরানোর সিদ্ধান্ত হলে তা মোটেই মানা যাবে না।’’ সাক্ষীগোপালবাবুও বলেছেন, ‘‘সব দরজা বন্ধ করে দিলে হবে না। যাঁরা থাকতে চাইবেন না, তাঁদের জন্য স্বেচ্ছাবসরের রাস্তাটা খোলা রাখার দাবি জানাব আমরা।’’
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য আগেই বলেছেন, ‘‘স্বেচ্ছাবসরের ব্যবস্থা অবশ্যই রাখা উচিত। সরকার সেটাও ভাবছে।’’ কিন্তু শিক্ষক-চিকিৎসকেরা তাঁর এই মুখের কথায় আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তাঁদের বক্তব্য, না আঁচালে বিশ্বাস নেই!