অশান্ত ভাঙড়। — ফাইল চিত্র।
এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে অত্যন্ত চর্চিত শব্দ ‘প্রতিরোধ’। একতরফা মার না খেয়ে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে বিরোধীরা। আবার বিরোধীদের দিক থেকে বাধা এলে শাসক দলের প্রতিরোধের কথা বলছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পঞ্চায়েতের মনোনয়ন-পর্বে অন্তত প্রতিরোধের যে ছবি দেখা গিয়েছে, তাতে আলাদা করে নজরে আসছে সংখ্যালঘু এলাকা। রাজ্যের বেশ কিছু সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত এলাকায় প্রতিরোধের মাত্রা এ বার বেশি। যা দেখে সংখ্যালঘু মনে পরিবর্তনের ইঙ্গিত খুঁজছে বিরোধী শিবির। প্রকাশ্যে ‘বিক্ষিপ্ত ঘটনা’ বলে দাবি করলেও প্রতিরোধের এই প্রবণতা ভাবনায় রেখেছে শাসক শিবিরকেও।
রানিনগর, ডোমকল, ভাঙড় থেকে শুরু করে ইসলামপুর, চোপড়ায় মনোনয়ন জমা দেওয়াকে ঘিরে হামলা এবং পাল্টা প্রতিরোধের ঘটনা ঘটেছে। বিরোধীদের দাবি, প্রথমে শাসক দলের বাধার মুখে পিছু হটলেও পরে ‘মানুষকে সঙ্গে নিয়ে’ তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছে। এই ধরনের ঘটনা যে সব জায়গায় ঘটেছে, তার বেশির ভাগই সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত। মনোনয়ন-পর্বে এখনও পর্যন্ত যে কয়েক জনের (বিরোধীদের দাবি ৬, মতান্তরে ৭) মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই সংখ্যালঘু। এঁদের মধ্যে শাসক দলের লোকও আছেন। দু’বছর আগে বিধানসভা নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোট প্রায় নিরঙ্কুশ ভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের বাক্সে গিয়েছিল। সেই প্রেক্ষিতেই এ বারের প্রতিরোধের প্রবণতার মধ্যে সংখ্যালঘুদের মন বদলের অঙ্ক খুঁজছেন বাম ও কংগ্রেস নেতারা। আর বিজেপি মনে করছে, সংখ্যালঘু ভোটে বাম-কংগ্রেস ভাঙন ধরাতে পারলে আখেরে তৃণমূলের বিপদ হবে এবং অন্যান্য এলাকায় তৃণমূলের মোকাবিলায় বিজেপি আরও বেশি ঝাঁপাবে।
ভাঙড়ে ‘প্রতিরোধে’র মুখ হয়ে উঠেছেন ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের (আইএসএফ) চেয়ারম্যান তথা বিধায়ক নওসাদউদ্দিন সিদ্দিকী। তাঁর মতে, ‘‘বিধানসভা নির্বাচনে সিএএ-এনআরসি’কে কেন্দ্র করে বিজেপি এবং তৃণমূলের মধ্যে মেরুকরণ করা হয়েছিল। আমরা সংযুক্ত মোর্চার তরফে চেষ্টা করেও সেটা ঠেকাতে পারনি। কিন্তু তার পরে মানুষ, যার মধ্যে সংখ্যালঘুরাও আছেন, আরও স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পেরেছেন, বিজেপি ও তৃণমূল একই মুদ্রার দুই পিঠ। তাই এখন নিজেদের ভোট লুট রুখতে সংখ্যালঘুরা প্রতিরোধে এগিয়ে আসছেন।’’ রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের অবশ্য পাল্টা দাবি, ‘‘আইএসএফ-কে সামনে রেখে বিজেপির দিক থেকে সংখ্যালঘু মানুষকে ভুল বোঝানোর একটা চেষ্টা হয়েছে। সেটা এখন ধরা পড়ছে। আমরা এই নিয়ে চিন্তিত নই। আর সার্বিক ভাবেও রাজ্যের প্রায় ৬৪ হাজার বুথের মধ্যে অল্প কয়েকটায় বিরোধীদের মদতে অশান্তি হয়েছে। এ বারের পঞ্চায়েত এখনও পর্যন্ত সব চেয়ে শান্তিপূর্ণ।’’
বাম জমানায় রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং অধুনা প্রদেশ কংগ্রেস নেতা হাফিজ আলম সৈরানির দাবি, ‘‘বিধানসভা নির্বাচনে একটা আশঙ্কা ছিল, যদি বিজেপি কোনও ভাবে ক্ষমতায় এসে যায়। তাই বিজেপিকে রুখতে সংখ্যালঘুরা এককাট্টা হয়ে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছিলেন। এখন বিজেপির সেই ভীতি নেই, সংখ্যালঘুরাও কংগ্রেস এবং বামের দিকে আসছেন। সাগরদিঘির বিধানসভা উপনির্বাচন থেকেই সেটা দেখা গিয়েছে।’’ মুর্শিদাবাদ, মালদহের মতো জেলায় বেশ কিছু সংখ্যালঘু কর্মী-সমর্থক শাসক দল ছেড়ে ইতিমধ্যে কংগ্রেসে যোগও দিয়েছেন। সিপিএমের অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণ বলছে, বিধানসভা ভোটের সময়ে দলের মিছিলে হেঁটেছেন, এমন লোকজনও বুথে গিয়ে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছিলেন। এখন পরিস্থিতি তেমন নয়। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘তৃণমূলকে ভালবেসে সব সংখ্যালঘু মানুষ তাদের ভোট দিয়েছিলেন, এমন নয়। এখন পরিস্থিতি বদল হতেই তাঁদের মনোভাবে পরিবর্তনও দেখা যাচ্ছে।’’
রাজ্যে বড় কোনও আন্দোলন বা প্রতিবাদে সংখ্যালঘু মানুষকে সামনের সারিতে দেখা গিয়েছে আগেও। তবে আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে এই পঞ্চায়েতে ‘বিক্ষিপ্ত প্রতিরোধ’ শাসক তৃণমূলের অন্দর মহলে আলোচিত হচ্ছে। প্রকাশ্যে তাঁরা এর মধ্যে আলাদা তাৎপর্য আছে বলে যদিও মনে করছেন না। শাসক দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের কথা বলছি আমরা। তার মধ্যেও সংখ্যালঘু এলাকায় এমন ছবি দেখা যাচ্ছে। হতে পারে, এঁদের একাংশ কারও হাতে ব্যবহৃত হচ্ছেন। কিন্তু যা-ই হোক না কেন, বিষয়টা সংবেদনশীল এবং উদ্বেগজনক।’’