প্রতিরোধই রাস্তা, বিধানসভার আগে বার্তা পাঁচ সেনাপতির

শাসক দলের বিরুদ্ধে রিগিং, সন্ত্রাসের অভিযোগ করে ঘরে বসে থাকা নয়। দলের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ময়দান কামড়ে পড়ে থাকলে যে সুফল মেলে, এই পুরভোট তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। একই সঙ্গে স্পষ্ট হল— পেশি বা অন্য শক্তিতে অনেক বেশি বলীয়ান প্রতিপক্ষের সঙ্গে অসম যুদ্ধে জিততে হলে দরকার উপযুক্ত সেনাপতির। যিনি একই সঙ্গে যেমন সংগঠনের শক্তি বাড়ানোর দিকে মন দেওয়ার পাশাপাশিই রাস্তায় নেমে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার সাহসও দেখাবেন।

Advertisement

রোশনী মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৫১
Share:

শাসক দলের বিরুদ্ধে রিগিং, সন্ত্রাসের অভিযোগ করে ঘরে বসে থাকা নয়। দলের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ময়দান কামড়ে পড়ে থাকলে যে সুফল মেলে, এই পুরভোট তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। একই সঙ্গে স্পষ্ট হল— পেশি বা অন্য শক্তিতে অনেক বেশি বলীয়ান প্রতিপক্ষের সঙ্গে অসম যুদ্ধে জিততে হলে দরকার উপযুক্ত সেনাপতির। যিনি একই সঙ্গে যেমন সংগঠনের শক্তি বাড়ানোর দিকে মন দেওয়ার পাশাপাশিই রাস্তায় নেমে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার সাহসও দেখাবেন।

Advertisement

শিলিগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ এবং কাটোয়া— এই পাঁচ জায়গায় বিরোধী শিবিরের পুরোভাগে লড়াকু সেনাপতিরা ছিলেন, যাঁরা শাসক দলের কোনও আক্রমণের মুখেই ময়দান ছেড়ে যাননি। সংগঠনকে বাঁচিয়ে রেখে নিজেরাই রাস্তায় নেমে লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছেন। শিলিগুড়িতে অশোক ভট্টাচার্য, কোচবিহারে উদয়ন গুহ, উত্তর দিনাজপুরে দীপা দাশমুন্সি, মুর্শিদাবাদে অধীর চৌধুরী এবং কাটোয়ায় রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় তৃণমূলের সঙ্গে সমানে টক্কর দিয়ে রক্ষা করেছেন বিরোধী গড়। বিপরীতে, বিরোধী পক্ষে উপযুক্ত সেনাপতির অভাবেই ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল-সহ হুগলি নদীর দুই তীরে সবুজ ছাড়া আর সব রং কার্যত মুছে গিয়েছে! রাজনৈতিক শিবিরের মতে, বিরোধীরা পুর-ময়দান থেকে এই শিক্ষা নিয়ে ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে নামলে তৃণমূলের পক্ষে লড়াইটা অনেক কঠিন হয়ে যাবে।

শিলিগুড়িতে সিপিএম তথা বামেদের মুখ হিসেবে লড়ার জন্য চারটি কৌশল নিয়েছিলেন অশোকবাবু। এক, সারা বছর নানা প্রশ্নে লাগাতার আন্দোলন করে গিয়েছেন। দুই, কর্মীদের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রেখে গিয়েছেন। তিন, মানুষের পাশে থেকে তাঁদের কথা মন দিয়ে শুনেছেন ও চার, ভোটের দিন শাসক দলের গণ্ডগোলের চেষ্টা রুখে দেওয়ার জন্য কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তৈরি থেকেছেন। অশোকবাবুর কথায়, ‘‘কলকাতার ভোটের অভিজ্ঞতা জেনে শিলিগুড়ির ভোটে লুঠ রোখার জন্য আমরা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। মানুষকে ভোটকেন্দ্রে পাঠানোর জন্য চেষ্টা করেছি। অন্য বিরোধীদেরও বলেছিলাম, ভোটারদের বুথে যাওয়াটা নিশ্চিত করবেন। এই কৌশলে কাজ হয়েছে।’’

Advertisement

কোচবিহারের তৃণমূল জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ প্রচারে নেমে দলের প্রার্থীদের ‘সরকারি প্রার্থী’ বলে তাদের ভোট দেওয়ার আবেদন জানানোর পাশাপাশি ‘পুলিশ-প্রশাসন আমাদের সঙ্গে আছে’ বলে মন্তব্য করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। তাঁর এই বক্তব্যের পরে তৃণমূলের হয়ে ‘বাহুবলী’রা রাস্তায় নেমেছিল বলে অভিযোগ। জেলার চারটি পুরসভার মধ্যে তিনটিই তৃণমূলের দখলে গেলেও জেলা জুড়ে তাদের বিজয় রথ দিনহাটায় রুখে দিয়েছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক তথা বিধায়ক উদয়ন গুহ। কোচবিহারেও তৃণমূলের জয় নিরঙ্কুশ হয়নি। ফব সূত্রের বক্তব্য, দিনহাটায় ইটের বদলে পাটকেলের দাওয়াই দিয়েছিলেন উদয়নবাবু। নির্দেশ ছিল— তৃণমূল একটা মারলে দশটা মার ফিরিয়ে দিতে হবে। তৃণমূল একটা পতাকা ছিঁড়লে পাল্টা দশটা পতাকা ছিঁড়তে হবে। পাশাপাশি পুলিশ-প্রশাসনের উপরে চাপ রেখে যেতে হবে। ভোটের দিন বহিরাগতরা ঢুকলে যাতে বেরোতে না পারে, সে জন্যও ছিল প্রস্তুতি। দিনহাটায় হারের পরে তৃণমূলের অভিযোগ, ফব দেদার টাকা বিলি করেছে। উদয়নবাবু যা উড়িয়ে পাল্টা বলেছেন, “শাসক দলের সঙ্গে আমরা সন্ত্রাস ও টাকা দিয়ে পেরে উঠব, এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। আসলে রবীন্দ্রনাথবাবু দিনহাটায় হেরে গিয়ে মুখ রক্ষা করতে এ সব বলছেন।” একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ব্যক্তিগত ভাবে যেটা আমার জয়, সেটা রবীন্দ্রনাথ ঘোষকে উৎসর্গ করলাম!’’ দিনহাটা ফব-র বহু পুরনো এবং শক্ত ঘাঁটি। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটে হেরে সেখানেও কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল ফব। সেই অবস্থা থেকে দলকে তুলে আনতে এ বার নিজেই কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়ে সামনে থেকে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন উদয়নবাবু। পুরসভায় দলের জয় নিশ্চিত করতে প্রতি ওয়ার্ডে চষে বেড়িয়েছেন। নিট ফল? নিজে জেতার পাশাপাশি দলকেও জিতিয়ে ধরে রেখেছেন দিনহাটা পুরসভা।

উত্তরবঙ্গের আর এক সেনাপতি দীপা দাশমুন্সি। অন্যদের তুলনায় তাঁর লড়াই আরও কঠিন ছিল। কারণ অন্যরা নিজের নিজের গড়ে বাস করেন। কিন্তু অসুস্থ স্বামী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির দেখভালের জন্য দীপাকে বেশির ভাগ সময়ই দিল্লিতে থাকতে হয়। তার উপর কংগ্রেসের অন্দরের সমীকরণে প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ‘শীতল’। এক বছর আগে লোকসভা ভোটে নিজে হেরে গিয়েছেন। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও নিয়মিত এলাকায় গিয়ে দলীয় কর্মী এবং মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে গিয়েছেন প্রিয়-পত্নী। তাতেই কালিয়াগঞ্জ ও ইসলামপুরে বাজিমাত কংগ্রেসের। দীপা বলেন, ‘‘লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে দিইনি। সন্ত্রাস রোখার মতো শক্তি পেয়েছিলাম বলেই মানুষ ভোটটা এখানে দিতে পেরেছেন। লোকসভায় অনেকেই হয়তো ভুল করে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। পরে তাঁরা আফশোস করেছেন। সব মিলিয়ে আমরা কালিয়াগঞ্জ তৃণমূল শূন্য এবং ইসলামপুর বাম শূন্য করতে পেরেছি।’’

এই পুরভোটেও মুর্শিদাবাদের গড় সামলে রেখেছেন অধীর। তাঁর নেতৃত্বেই মুর্শিদাবাদ এবং কান্দি পুরসভা ফের দখল করেছে কংগ্রেস। অধীরের কথায়, ‘‘মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের কোনও জায়গা নেই। আর বিজেপির বেলুন গোটা পশ্চিমবঙ্গেই চুপসে গিয়েছে!’’ কাটোয়া পুরসভা কংগ্রেসের থেকে ছিনিয়ে নিতে এ বার মরিয়া ছিল তৃণমূল। ভোটের দিন সেখানে সকাল থেকেই তাণ্ডব চলেছে। তার পরেও সেখানে ২০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১০টি ধরে রেখেছে কংগ্রেস। কাটোয়ার সেনাপতি কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যত সন্ত্রাসই হোক, ময়দান না ছাড়ার পণ করেছিলাম। তাই এই ফল।’’ রবীন্দ্রনাথবাবু জানান, নিয়ম অনুযায়ী, এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস এবং তৃণমূল দু’ পক্ষই বোর্ড গড়তে চাইলে টস হবে। কিন্তু তাঁরা বোর্ড গড়ার চেষ্টা করবেন না। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘কংগ্রেস টসে জিতলে বোর্ডের কাজে বাধা দেবে সরকার। আর শহরে সারা বছরই একটা অশান্তির পরিবেশ থাকবে। সে জন্যই এই সিদ্ধান্ত।’’

এই পাঁচ দৃষ্টান্তের উল্টো দিকে উত্তর ২৪ পরগনা। যেখানে শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার মতো খুব বেশি বিরোধী নেতার দেখা মেলেনি! এরই মধ্যে মধ্যমগ্রামের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ব্যতিক্রমী লড়াই করে বাহুবলী হিসেবে পরিচিত তৃণমূল প্রার্থী বিনোদ সিংহকে হারিয়েছেন সিপিএম প্রার্থী সনৎ কুমার বিশ্বাস। ভোটের দিন বুথের মধ্যে মার খেয়েও তিনি এলাকা ছাড়েননি। আহত অবস্থায় মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন। যা দেখে বাম কর্মী-সমর্থকরাও সে দিন ময়দান ছাড়েননি। ভোট মেটার পরে এখন তিনি আর জি কর হাসপাতালে ভর্তি। ওয়ার্ডটা কিন্তু তিনিই জিতেছেন!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement