জনতার হামলায় ভাঙচুর পুলিশের গাড়ি। মঙ্গলবার নওদা-যদুপুরে। নিজস্ব চিত্র।
স্কুল ছাত্রকে পিটিয়ে খুনের ঘটনায় ফের তেতে উঠেছে কালিয়াচকের নওদা যদুপুর। আর আতঙ্ক গ্রাস করেছে গোটা এলাকাকে। কী ঘটবে এর পর? সেই প্রশ্নই এখন ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে বাসিন্দাদের মনে।
অভিযোগ, গ্রাম পঞ্চায়েত ও এলাকায় কর্তৃত্বের রাশ নিজেদের দখলে রাখা নিয়ে গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে এলাকার দুই ত্রাস বকুল শেখ ও জাকির শেখের গোষ্ঠীর লড়াই চলছে। আর এর জেরে খুন-জখমের ঘটনাও ঘটে চলেছে লাগাতার। ঘটনাচক্রে দু’জনই এক সময় শাসকদলের ঘনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু দলবিরোধী কাজের অভিযোগে বকুলকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু এখনও তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রাই পঞ্চায়েতের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, দুই শিবিরের লড়াইয়ে বারবার এলাকার শান্তিভঙ্গ হলেও শাসকদল বা প্রশাসন সেভাবে কেউই কোনও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করতে পারেনি। এমনকী, এ বারের বিধানসভা ভোটে এলাকা থেকে জোট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী জিতলেও এসব নিয়ে তাদেরও কোনও হেলদোল নেই। এলাকায় লাগাতার অশান্তি চলায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বাসিন্দারা। পরিত্রাণ পেতে এলাকারই কিছু মানুষ নাগরিক কমিটি গড়ে সরব হতে শুরু করেছেন।
স্থানীয় সূত্রে খবর, কালিয়াচক ১ ব্লকের নওদা-যদুপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা বরাবরই কংগ্রেসের ঘাঁটি ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পর থেকে কংগ্রেসের সেই দখলদারি ফিকে হতে শুরু করে এবং দাপট বাড়ে রাজ্যের বর্তমান শাসকদল তৃণমূলের। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে, ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রাম পঞ্চায়েতের ২৩টি আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয় তৃণমূল। কিন্তু পঞ্চায়েতে কার কর্তৃত্ব থাকবে বা পদাধিকারী কারা হবেন তা নিয়ে শাসকদলের তৎকালীন অঞ্চল সভাপতি বকুল শেখ ও পঞ্চায়েত সদস্য জাকির শেখের মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত হয়।
জাকির শেখের অনুগামীদের অভিযোগ, বোর্ড গঠনের সময় জাকিরকে উপ প্রধানের পদ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বকুল জাকিরকে না দিয়ে রাজু শেখকে ওই পদে বসায় ও প্রধানের পদে বসায় নিজের ভ্রাতৃবধূ ফারহানা বিবিকে। অভিযোগ, সেই সময় থেকেই বকুল ও জাকিরের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিবাদ চরমে ওঠে। এবং এই বিবাদ ঘিরেই রাতের ঘুম ছুটে যায় এলাকার মানুষের।
এলাকার দখলদারি ও পঞ্চায়েতের কর্তৃত্ব নিয়ে সংঘর্ষ, বোমাবাজি, খুন-জখমের পালা লাগাতার চলতে থাকে। দুই শিবিরের লড়াইয়ে গত দু’বছরে প্রায় আট জনের মৃত্যু হয়। প্রাণ যায় যার বেশ কিছু নিরীহ মানুষেরও। গোলমাল থামাতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন পুলিশ কর্মীরাও। লাগাতার এই অশান্তির জেরে একাধিক মামলা হলেও অধরাই থেকে গিয়েছে দুই গোষ্ঠীপতি।
লাগাতার খুন জখমের রাজনীতি চলতে থাকায় শেষ পর্যন্ত, গত বছর জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব বকুলকে দল থেকে বহিষ্কার করে ও জাকির ঘনিষ্ঠ গোলাম কিরদিয়াকে সভাপতি করে। তবে ভ্রাতৃবধূ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান থাকায় বকুলের দাপট কিন্তু কমেনি। বিধানসভা ভোটের আগেও দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ জারি ছিল। মাঝে ভোটের ফল ঘোষণার পর অশান্তি কিছুটা কমলেও গত সপ্তাহ থেকে ফের উত্তপ্ত হচ্ছে ওই এলাকা। বাসিন্দারা বলেন, ‘‘বকুল-জাকির গোষ্ঠীর লড়াইয়ে এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সন্ধে হলেই আতঙ্কে মানুষ ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছুই নেই। প্রশাসনও উদাসীন।’’
এ বারের বিধানসভা ভোটে এলাকায় কংগ্রেস জিতলেও শাসকদলের ওই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে তারাও নিশ্চুপ। যদিও দলের জেলা সভানেত্রী মৌসম নূর বলেন, ‘‘নওদা যদুপুরে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে চলা খুন-জখম বন্ধ করার ব্যপারে এ দিনই আমরা পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করেছি। কাজ না হলে আন্দোলনও হবে।’’ তৃণমূলের জেলা সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন অবশ্য গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা মানতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘ওখানে দুষ্কৃতীদের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই। আমরা পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’’
পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গোলমাল হলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’’ এ দিকে, এলাকায় শান্তি ফেরানোর শপথ নিয়ে গঠিত হয়েছে উত্তর দরিয়াপুর বাইশি নাগরিক কমিটি। কমিটির সভাপতি ইদ্রিশ আলি বলেন, ‘‘শান্তি চাই। পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনুক।’’