লোহার বিম বসিয়ে পোক্ত করা হচ্ছে মহাকরণের ছাদ। -নিজস্ব চিত্র
মহাকরণ ছাড়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ছ’মাসের মধ্যেই ফিরে আসছেন। দিনটা ছিল ২০১৩-এর ৫ অক্টোবর। তার পরে তিন তিনটে বছর কেটে গিয়েছে।
এত সময় লাগছে কেন মহাকরণের সংস্কারে? পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা বলছেন, সংস্কারের কাজে হাত পড়েছে সবে বছর খানেক। তার আগে ইট-সুরকির কাঠামোর পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেই সময় গিয়েছে। তাঁদের কথায়, ২৩৯ বছরের পুরনো ওই ভবন যে ভিতরে ভিতরে এত জীর্ণ হয়েছে তা খালি চোখে ধরা পড়েনি। কোথাও কড়ি-বরগায় উই ধরেছে, স্লেট পাথরে জল চুঁইয়ে ম্যানসার্ডগুলো (উঁচু ছাদওলা হলঘর) কমজোরি হয়েছে। আদত আদল ফিরিয়ে আনতে গিয়ে ওই নষ্ট অংশের মেরামতিই পূর্ত দফতরের কাছে বড় চ্যালে়ঞ্জ।
এর মধ্যে অবশ্য স্বাধীনতার পরে তৈরি হওয়া মহাকরণের বেশ কিছু অতিরিক্ত নির্মাণ গুঁড়িয়ে দিয়েছে পূর্ত দফতর। সরকারি নথি বলছে, ১৭৭৭-এ মহাকরণের গোড়াপত্তনের পরে তিন দফায় এর বপু বাড়ায় ব্রিটিশেরা। এমনকী, ১৯৪৭-এও তাদের নজরদারিতে নির্মাণ কাজ হয়েছে। মহাকরণের নথি অনুযায়ী, দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও এর পরিসর বাড়ার কাজ থামেনি। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৮, মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে মূল পরিকাঠামোর ফাঁকে আরও ৪টি ভবন তৈরি হয়। তাতেও স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় মহাকরণের ছাদে তৈরি হয় পায়রার খোপের মতো সারি সারি ঘর। সে সব ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে মহাকরণের যে চেহারা হয়েছে, এত দিন যাঁরা সেখানে যাতায়াত করেছেন, দেখলে চিনতেই পারবেন না।
পূর্ত দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ার বলেন, ‘‘সংস্কার তো শুধু ভাঙাভাঙি নয়। পুরনো চেহারা ফিরিয়ে দেওয়ার কাজে হাত দেওয়ার আগে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়েছে। তার রিপোর্ট পেয়ে তবেই পরবর্তী পদক্ষেপ নির্দিষ্ট হচ্ছে। এতেই সময় লাগছে।’’
কী সেই পরীক্ষা? পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা বলছেন, মহাকরণের দেওয়াল দু’ফুট চওড়া। তার গভীরে কোনও ফাটল তৈরি হয়েছে কি না, পলেস্তারা চটিয়ে তা দেখা হয়েছে। একই সঙ্গে ২৩৯ বছর আগে তৈরি ওই কাঠামো এখনও কতটা পোক্ত রয়েছে, তা জানতে ভবনের বেশ কিছু অংশ কেটে ভিতরের চুন-সুরকি পরীক্ষা করেন বিশেষজ্ঞরা। দু’টি ইটের মধ্যে আঁট কতটা, বিদ্যুতের তার ঢুকিয়ে সে সব নিরীক্ষার পর্ব শেষ করে তবেই সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে।
দেওয়াল কেটে ইঞ্জিনিয়ারেরা দেখেছেন, মহাকরণের যে সব অংশ স্বাধীনতার আগে তৈরি হয়েছিল সেখানে তিন খোপের ফাঁপা ইট রয়েছে। কাঠামোর ওজন কমানোর পাশাপাশি বাড়ি ঠান্ডা রাখতে ব্রিটিশ পূর্ত বিভাগ ওই ইট ব্যবহার করেছিল বলে মনে করছেন ইঞ্জিনিয়াররা।
সরকারি নথি বলছে, কেরানিরা থাকবেন বলে গোড়ায় মহাকরণকে ব্যারাকের আদলে বানানো হয়েছিল। ১৮২১ সালে সামনের বারান্দাটি মূল ভবনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। ১৮৭৯-তে ফের সেটির সংস্কার হয়। তত দিনে অনেক সরকারি অফিসই মহাকরণে চলে এসেছে। এই সময়েই দফায় দফায় ৫টি নতুন ব্লক তৈরি করে ব্রিটিশ প্রশাসন। এক ইঞ্জিনিয়ার জানান, মূল ব্লক ও জুড়ে দেওয়া বারান্দার মধ্যে ছাদের উপরের দিকে চিড় মিলেছে। চিড় যাতে আর না বাড়ে, সে জন্য লোহার বিম ঢুকিয়ে জোড় পোক্ত করার কাজ চলছে।
উনিশ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশরা যে নকশা ধরে এই ভবন সংস্কার করেছিল, তা মহাকরণের গ্রন্থাগারেই মিলেছে। দেখা গিয়েছে, দেশ ছাড়ার আগের বছরগুলিতে ব্রিটিশরা যে ব্লকগুলি নতুন করে তৈরি করেছিল, সেগুলির স্থাপত্যশৈলী আলাদা। আগের সুক্ষ্ম কারুকাজ উধাও। স্থপতিদের একাংশের ধারণা— ভারত ছাড়তে হবে, এ রকম একটা বার্তা পেয়েই আর শৈলীর দিকে তাকায়নি ব্রিটিশরা। কেবল মহাকরণের পরিসর বৃদ্ধির উপরেই জোর দিয়েছিল।