ছেলে হারানোর কান্না ভানুভূষণ জানার।
সবংয়ে ছাত্র খুনের ঘটনায় শুক্রবার নাম না-করে কৌশলে কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদের (সিপি) দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও তাঁর দেওয়া ঘটনার বিবরণের সঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের ফারাক ছিল বিস্তর। সেই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সাংবাদিক বৈঠক ডেকে কার্যত মুখ্যমন্ত্রীর তত্ত্বেই সিলমোহর দিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ। যদিও এ দিনই সকালে আদালতে দাঁড়িয়ে ‘তদন্তের স্বার্থে’ ধৃত তিন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ সমর্থককে হেফাজতে চেয়েছে পুলিশ। পেয়েওছে। বিরোধীদের প্রশ্ন, তা হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কী করে এমন মন্তব্য পুলিশ সুপার করলেন! তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই কী ভাবে তিনি নিহত কৃষ্ণপ্রসাদ জানা যে সংগঠনের সদস্য, সেই ছাত্র পরিষদকেই কার্যত কাঠগড়ায় তুললেন?
সবংয়ে ছাত্র হত্যার ঘটনায় শেখ মুন্নাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাড়িতে ভেঙে পড়েছেন মুন্নার মা।
ভারতী ঘোষ এ দিন দাবি করেন, ‘‘কলেজের সিসিটিভি-র ফুটেজে দেখা যাচ্ছে একটি দলই দাপাচ্ছে।’’ এমনকী, নিহত ছাত্রকে সেই দলের সঙ্গে মিশে হুমকি দিতে দেখা গিয়েছে বলেও দাবি তাঁর। বিরোধীদের অভিযোগ, এর আগে একাধিক ঘটনার মতো, এ বারও শাসক দলের কর্মী-সমর্থকদের গা বাঁচানোর মতো একটি তত্ত্ব মুখ্যমন্ত্রী প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। পুলিশ সুপার সেই তত্ত্বকেই সিলমোহর দেওয়ার কাজে অবতীর্ণ হয়েছেন। সবংয়ের কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার কথায়, “রাজ্যে কোনও ঘটনা ঘটলেই মুখ্যমন্ত্রী তদন্তের আগে দিকনির্দেশ করে দেন। সবংয়ের ঘটনাতেও তিনি গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা বলে দিয়েছেন। ফলে, পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ দক্ষ হলেও সেই দিকনির্দেশের বাইরে যেতে পারছেন না।”
এ দিন নবান্নে সবর্দল বৈঠকে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, ‘‘আপনি কী করে বললেন, ‘নিজেদের মধ্যে ধস্তাধস্তি করে ছেলেটি মারা গিয়েছে’?’’ একই প্রশ্ন তোলেন কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য দাবি করেন, তিনি অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা বলেননি। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও আশ্বাস দেন।
যদিও সন্ধ্যা ৬টায় সর্বদল বৈঠক শেষ হওয়ার পনেরো মিনিটের মধ্যে মেদিনীপুর শহরে সাংবাদিক বৈঠক করেন পুলিশ সুপার। তিনি জানান, কলেজে ১৫টি সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। তার একটা কাজ করছিল না। তাঁর দাবি, ‘‘বাকি ক্যামেরাগুলি থেকে পাওয়া ফুটেজে কৃষ্ণপ্রসাদ খুনে অভিযুক্ত ছ’জনের হাতে লাঠি দেখা যায়নি। বরং ফুটেজে অভিযোগকারী সবং কলেজের সিপি পরিচালিত ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সৌমেন গঙ্গোপাধ্যায়কে বারবার দেখা গিয়েছে।’’ আর তার পরেই শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বলার পরে তাঁর তত্ত্বে সিলমোহর দেওয়ার জন্য যদি পুলিশ যুক্তি সাজায়, তা হলে কি কলেজের সিসিটিভির ক্যামেরাগুলোও সেই কাজই করছে?’’
শিক্ষামন্ত্রীর দাবি উড়িয়ে বিরোধী শিবির অবশ্য এ দিনের ঘটনাক্রমের দিকে নজর দিতে বলছে। এ দিন সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে মেদিনীপুর আদালতে হাজির করানো হয় কৃষ্ণপ্রসাদ খুনে শুক্রবার রাতে গ্রেফতার হওয়া তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর তিন কর্মী-সমর্থক সানোয়ার আলি, অসীম মাইতি এবং শেখ মুন্না আলিকে। ধৃতদের জেরা করার জন্য পাঁচ দিন হেফাজতে চেয়ে পুলিশ যে কাগজপত্র জমা দেয়, তার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর শুক্রবারের বক্তব্যের ফারাক স্পষ্ট।
আদালতে পুলিশ জানায়, শুক্রবার সবংয়ের সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়ে ছাত্র পরিষদ এবং টিএমসিপি-র মধ্যে মারামারি হয়েছিল। সরকার পক্ষের আইনজীবী দেবপ্রসাদ চন্দ্রও বলেন, “সবং কলেজে ছাত্র পরিষদের সঙ্গে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের গোলমাল হয়। তার জেরেই ঘটনাটি ঘটেছে।” মুখ্যমন্ত্রী শুক্রবার বলেছিলেন, ‘‘ছাত্র পরিষদের ইউনিয়ন রুম লক করে ভিতরে সংঘর্ষ হয়।’’ কিন্তু পুলিশের জমা দেওয়া নথি অনুযায়ী, মারামারি হয়েছিল কলেজ চত্বরে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ব্যাটের আঘাতে মৃত্যু হয়েছে ওই ছাত্রের। কিন্তু আদালতে পুলিশ জানিয়েছে, যা দিয়ে নিহতের মাথায় আঘাত করা হয়েছে, সেটি উদ্ধার করতে হবে। সেটি কী, তা এখনও অজানা। অভিযুক্ত তিন জনের হয়ে এ দিন আদালতে কোনও আইনজীবীও ছিলেন না। দলীয় স্তরেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। যা ধৃতদের থেকে নিজেদের দূরত্ব বাড়ানোর চেষ্টা বলেই মনে করা হচ্ছে। দুপুরে ধৃতদের চার দিনের জন্য পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন মেদিনীপুরের ভারপ্রাপ্ত সিজেএম সুস্মিতা খান। তার পর সন্ধ্যায় পুলিশ সুপারের সাংবাদিক বৈঠক।
ভারতী ঘোষের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘কোর্টে জানানোর আগে সিসিটিভি ফুটেজ দেখা হয়নি। সিসিটিভি ফুটেজ মিথ্যা বলতে পারে না। সাধারণ মানুষকে সত্য জানানোর দরকার আছে।’’ পুলিশ সুপারের দাবি, ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ইউনিয়ন রুমের আলমারির পাশ থেকে লাঠি তুলে একদল ছেলে বেরিয়ে যাচ্ছে। সেই দলটিই কলেজ কাঁপাচ্ছে। কেউ কেউ তাদের দেখে দৌড়ে পালাচ্ছে।
দলে ১৪-১৫ জন ছেলে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘কৃষ্ণপ্রসাদ ওই দলের সঙ্গেই ছিলেন। তিনি কয়েক জনকে হুমকিও দেন। কিন্তু ছেলেটিকে একটা সময়ের পরে আর দেখা যাচ্ছে না। খুনের সময়ের ফুটেজও নেই।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘নিজেদের মধ্যে মারামারি করার ফলে ঘটনাটি ঘটেছে কি না, তদন্তে বার করে ফেলব।’’
পুলিশ সুপারের এমন দাবি রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘অস্বাভাবিক নয়’ মন্তব্য করে বিরোধীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে কলেজ চত্বরেই টিএমসিপি নেতারা মারধর করেছেন বলে অভিযোগ ওঠার পরে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য ছিল, ‘ছোট ছোট ছেলেরা একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে’। সে ঘটনায় অভিযুক্তদের ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তি হয়নি। পিংলায় বিস্ফোরণে ১৩ জনের মৃত্যুর পরে মুখ্যমন্ত্রী বিয়েবাড়ির বাজির তত্ত্ব দিয়েছিলেন। যদিও স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছিলেন, সেখানে বোমা বাঁধা হচ্ছিল। তার পর সিআইডি-র চার্জশিটে সেই বাজি কারখানার কথাই জানানো হয়েছে। বীরভূমের সাত্তোরের নির্যাতিতাকেও আক্রমণের নিশানা করে পুলিশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মমতা। মহিলার জামিন পাওয়া আটকাতে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়েছিল সরকার পক্ষ।
তবে ওই মহিলার জামিন পাওয়া ঠেকানো যায়নি।
এই সব ঘটনার সূত্রেই বিরোধীদের মত, সবংয়ে ছাত্র খুনেও ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি’ হতে চলেছে। সিপিএম সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান কোনও ঘটনা ঘটলেই নিজের সুবিধামতো একটা তত্ত্ব খাড়া করেন। ফলে, পুলিশ আর কী করে তার বাইরে যাবে?’’ এ দিন সবংয়ে গিয়ে নিহত ছাত্রের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। পরে তিনি বলেন, ‘‘উনি (মুখ্যমন্ত্রী) নিজের দলের লোককে বাঁচাতে এই নৃশংস হামলার পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন। ধৃতদের দ্রুত জামিনের ব্যবস্থা করার চক্রান্ত হচ্ছে।’’
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এ দিন শিলিগুড়িতে বলেছেন, ‘‘যদি ঘটনায় তৃণমূলের কেউ জড়িত থাকে তখন তাকে লঘু করা হবে। এটাই রাজ্যের নৈতিক দর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’ নিহত ছাত্রের পরিবারও আঙুল তুলছে পুলিশের দিকে। কৃষ্ণপদের দাদা হরিপদ এ দিন বলেন, ‘‘ঘটনাক্রম দেখে মনে হচ্ছে পুলিশ এক মুখে আমাদের তদন্ত হবে বলে সান্ত্বনা দিচ্ছে, আর অন্য দিকে ঘটনা ধামাচাপা দিতে চাইছে।’’
পুলিশের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার আরও কারণ রয়েছে বিরোধীদের কাছে। তাঁরা বলছেন, পুলিশ সুপার শুক্রবার জানিয়েছিলেন, কৃষ্ণপ্রসাদ ওই কলেজের নিয়মিত ছাত্র নন।
কেন তিনি ছাত্র সংসদের ঘরে গিয়েছিলেন তা দেখা হচ্ছে। এ দিন অবশ্য কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথম বর্ষে দু’বার অকৃতকার্য হলেও ফের ভর্তি হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অনুমতি লাগে তা কৃষ্ণপ্রসাদ পেয়েছিলেন। তাঁর কাছে কলেজের পরিচয়পত্রও ছিল। যদিও কৃষ্ণপ্রসাদকে খুনের অভিযোগে যে তিন জন ধরা পড়েছেন, তাঁদের মধ্যে শেখ মুন্নাও (টিএমসিপি-র কলেজ শাখার সম্পাদক) দু’বার অকৃতকার্য হয়েছেন। কিন্তু ফের ভর্তির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি ছিল না তাঁর। আর এক ধৃত সানোয়ার আলি (টিএমসিপি-র ব্লক সভাপতি) পিংলা কলেজের ছাত্র।
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ