জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। —ফাইল চিত্র।
বাড়ছে টাকার অঙ্ক।
এখনও পর্যন্ত জেরা, জিজ্ঞাসাবাদ এবং তল্লাশি করে যে তথ্য ইডির হাতে উঠে এসেছে, তাতে তদন্তকারীদের অনুমান, সব মিলিয়ে রাজ্যের রেশন বণ্টন দুর্নীতির মোট পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে।
এই দুর্নীতির মামলায় রাজ্যের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী ও বর্তমান বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এখন
জেলে। তার আগেই গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁরই ঘনিষ্ঠ চালকল মালিক বাকিবুর রহমান।
ইডি সূত্রের দাবি, রাজ্যের প্রায় ২১ হাজার ৩০০ রেশন দোকানের মধ্যে অধিকাংশ দোকানের মালিকের (দুর্নীতিতে জড়িত থাকুন বা না থাকুন) কাছ থেকে চার হাজার টাকা মাসোহারা নেওয়া হত। গত এক দশক ধরে নেওয়া ওই টাকার পরিমাণ কোনও ভাবেই ৭০০ কোটি টাকার কম হবে না বলে দাবি করেছেন তদন্তকারীরা।
তদন্তকারীদের সূত্রে এ-ও দাবি, এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩০০-র বেশি ভুয়ো রেশন দোকানের হদিস পাওয়া গিয়েছে। খাদ্য দফতরের কাগজে-কলমে ওই দোকানগুলি থাকলেও বাস্তবে ওই দোকানগুলির অস্তিত্ব এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইডি কর্তাদের সূত্রে দাবি, ওই সব দোকানের অনুমোদন দেখিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে ন্যায্য মূল্যের সামগ্রী নিয়ে তা খোলা বাজারে বিক্রি করা হয়েছে। এই খাতে গত ৭-৮ বছরে কম করে ১৫০ কোটি তোলা হয়ে থাকতে পারে বলেও তদন্তকারীদের দাবি।
এ ছাড়াও যে অনুমোদিত রেশন দোকানগুলি ‘দুর্নীতি-সিন্ডিকেটে’র সদস্য, তারাও রেশন সামগ্রী খোলা বাজারে বিক্রি করে গত এক দশকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা তুলেছে বলে প্রাথমিক তদন্তের পরে ইডি সূত্রের দাবি। তদন্তকারীদের আরও দাবি, ধান কেনার ক্ষেত্রেও ভুয়ো চাষিদের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে সহায়ক মূল্যের অন্তত ৫০ কোটি টাকা তোলা হয়ে থাকতে পারে।
মন্ত্রীর আপ্ত সহায়ক অভিজিৎ দাসের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া মেরুন ডায়েরির তথ্য, মন্ত্রী, তাঁর আর এক আপ্ত সহায়ক অমিত দে ও বাকিবুর-সহ মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের বাড়ি-অফিস থেকে উদ্ধার হওয়া নথি, বিভিন্ন জনকে জেরা ও জিজ্ঞাসাবাদের পরে তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, বাকিবুর দুর্নীতি চক্রের এই কোটি কোটি কালো টাকা ডিলার, ডিস্ট্রিবিউটর এবং রেশন দোকানের মালিকদের থেকে আদায় করতেন। আর এই দুর্নীতি প্রায় এক দশক ধরে সমান তালে চলছিল বলে দাবি করছে ইডি।
কোথায় গেল এত বিশাল পরিমাণ কালো টাকা?
তদন্তকারীদের স্বীকারোক্তি, এখনও পর্যন্ত সেই টাকার খুব সামান্য অংশ পর্যন্তই তাঁরা পৌঁছতে পেরেছেন। যার পরিমাণ মেরেকেটে ৫০ কোটি টাকার কাছাকাছি। বাকি বিপুল পরিমাণ টাকার একটা বড় অংশ বিদেশে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে ইডি সূত্র। ওই সূত্রের অভিযোগ, শুধু জ্যোতিপ্রিয় পর্যন্ত গিয়ে টাকার স্রোত থেমে যায়নি। সেই কালো টাকার একটি অংশ পৌঁছেছে অন্য ‘প্রভাবশালী’দের কাছেও।
কেন এমন ধারণা করছেন তাঁরা? তদন্তকারীদের দাবি, এখনও পর্যন্ত জেরা ও তল্লাশিতে পাওয়া সমস্ত তথ্যই জানাচ্ছে, রেশন বণ্টন দুর্নীতির কালো টাকার ভাগ হত ‘৫০-৫০’ পদ্ধতিতেই। একটি ভাগ পেতেন বাকিবুর-সহ দুর্নীতিতে জড়িত অন্যরা। আর অন্য ভাগটি মন্ত্রী ও তাঁর একেবারে ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা লোকেদের কাছে চলে যেত বলে দাবি ইডি-কর্তাদের। কিন্তু, মন্ত্রী ও তাঁর একেবারে কাছের লোকেদের বাড়ি ও অন্য সম্ভাব্য স্থান তল্লাশি করে এখনও পর্যন্ত এত বিশাল টাকা বা সম্পত্তির হদিস মেলেনি। তদন্তকারীদের একাংশের বদ্ধমূল ধারণা, বেশ কিছু টাকা বিদেশে হাওয়ালার মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু, তাতেও অঙ্কের হিসাব মেলাতে পারছেন না ইডি-কর্তারা। আর সেখানেই অন্য প্রভাবশালী যোগের সন্দেহ করছেন তাঁরা।
তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, হেফাজতে থাকাকালীন জ্যোতিপ্রিয়কে দীর্ঘ জেরায় ‘প্রভাবশালী’দের কাছে রেশন দুর্নীতির কালো টাকা নিয়মিত পৌঁছে দেওয়ার বেশ কয়েকটি মাধ্যম এবং সূত্র উদ্ধার হয়েছে।
‘ফিফটি ফিফটি’ তত্ত্বের সপক্ষেও যুক্তি দিচ্ছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের দাবি, রেশন দুর্নীতির কালো টাকার অর্ধেকের বেশি যে মন্ত্রীর কাছেই গিয়েছিল, তা বাকিবুর-সহ মন্ত্রীঘনিষ্ঠদের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এসেছে। তা ছাড়াও যে সব ভুয়ো সংস্থা মারফত রেশন দুর্নীতির কালো টাকা সাদা করা হয়েছে, সেখানকার লেনদেন থেকেও এমন তথ্য উঠে এসেছে বলে তদন্তকারীদের দাবি।
এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, "বাকিবুরের পরিবারের সদস্য ও মন্ত্রীর স্ত্রী ও মেয়েকে ডিরেক্টর করে তিনটি সংস্থা খোলা হয়েছিল। ওই সংস্থাগুলির মাধ্যমে প্রায় কুড়ি কোটি কালোটাকা সাদা করা হয়েছিল। পরে দেখা যায়, তার অর্ধেক, প্রায় ১০ কোটিটাকা মন্ত্রী ও তাঁর মেয়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’’ একই ভাবে বাঁকুড়ার দু’টি সংস্থা থেকেও এমন তথ্য পাওয়ার দাবি করেছেন তদন্তকারীরা।