Jagannath Dev

রাজনীতির রথচক্রে শিকড়ের যোগটা কোথায়

রাঁচীর জগন্নাথের রথও বংশপরম্পরা মেনে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় একটি মুসলিম পরিবার।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:১৪
Share:

ফাইল চিত্র।

জন্মসূত্রে অহিন্দু হলে পুরীর মন্দিরে সাধারণত ঢোকার জো নেই কারও। তবে জগন্নাথদেব রথে প্রকট হলে সেই নিয়ম শিথিল।

Advertisement

বহু বছর ধরে জগন্নাথের নন্দিঘোষ রথে তাঁর প্রবীণ সেবায়েত জগন্নাথ দয়িতাপতি বলছিলেন, “যাঁরা মন্দিরে তাঁর কাছে যেতে পারেন না, সেই মানুষগুলিকে কাছে টানতেই তো রথে বেরোন প্রভু। আমি নিজে বহু মুসলমান বা খ্রিস্টান ভক্তের অনুরোধে তাঁদের রথে জগন্নাথদেবকে স্পর্শ করিয়েছি।” রথে আসীন জগন্নাথকে দর্শন করলে আর জীবযন্ত্রণা সহ্য করতে হবে না, এই প্রাচীন লোক বিশ্বাস যুগ যুগ ধরে অগুনতি নামী-অনামী, ছোট-বড় মানুষকে পুরীতে রথের পথের ধারে টেনে আনে।

রাঁচীর জগন্নাথের রথও বংশপরম্পরা মেনে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় একটি মুসলিম পরিবার। মধ্য যুগ থেকে এ দেশের রথ-সংস্কৃতির মধ্যে মিশে রয়েছে জাতধর্ম নির্বিশেষে এক ধরনের সামাজিক দেওয়াল ভাঙার পরম্পরা। এই ২০২১এর রথচক্র মুখরিত রাজ্য-রাজনীতি ঘিরে সেই রথযাত্রাই খানিক অন্য ব্যঞ্জনা পাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের রথের রশি-র রথের দড়ি ছিল মানুষে মানুষে প্রাণে প্রাণে বন্ধনের প্রতীক। রাজ্যের পথে অবতীর্ণ এই রাজনীতির রথ যন্ত্রচালিত, বিলাসবহুল। এবং স্বভাবতই রশিবিহীন। তা ‘চলমান হোটেল’ বলে কটাক্ষ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছেন, “সীতাহরণের সময়ে রাবণ রথে চড়েই আসেন!” বিজেপি-শিবির এ সব খোঁচায় দৃকপাত না-করেই কর্মসূচিতে অটল।

Advertisement

বিজেপির ইতিহাসে তিন দশক আগে লালকৃষ্ণ আডবাণীর ‘রাম রথযাত্রা’র গরিমা প্রবল। তাদের রাজনীতির নানা বাঁকে রথ-কৌশল তাই ফিরে ফিরে আসে। “এত বার রথে কিন্তু স্বয়ং রামচন্দ্রও চড়েননি। তিনি রাবণের পুষ্পক রথ নিয়ে অযোধ্যায় ফেরেন,” বলছেন পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। তাঁর মতে, “রথ হল, রাজা বা দেবতাদের ব্যাপার! জানি না, এই নেতারা নিজেদের কী ভাবেন! আর রাম মানে যিনি রঞ্জন করেন, রাঙিয়ে দেন। রথ হাঁকিয়ে শৌর্যবীর্যের গর্বের থেকে রামচন্দ্রের আদর্শ
অনেক দূরের।”

রথের সঙ্গে বাংলার ইতিহাসের অন্য যোগসূত্রের কথা বলছিলেন শিল্প ইতিহাসের শিক্ষিকা সুমনা দত্ত। বাংলার পোড়ামাটির মন্দিরের শিল্পী এবং রথের রূপকারদের সূত্রধর বলা হয়। এখানে তারাপীঠের তারা মা, ভদ্রেশ্বরের অন্নপূর্ণা বা ডেবরার রামও রথে বেরোন। “কিন্তু বাংলার রথের শিল্পসুষমা বা ভক্তির আদর্শের সঙ্গে রাজনীতির রথ পুরো আলাদা”, বলছেন তিনি। নবদ্বীপে রথের পরিবর্তন যাত্রা-র সূচনা নিয়েও আপত্তি ছিল কোনও কোনও চৈতন্যভক্তের। মুগবেড়িয়ার নন্দবাড়ির ছোট ছেলে চৈতন্যময় নন্দের কথায়, “শ্রী চৈতন্যের কাছে মানুষে মানুষে ভেদ ছিল না। নবদ্বীপকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখাই উচিত।”

বাঙালির রথচেতনার গোড়া থেকেই চৈতন্যদেবের স্পর্শ। তাঁর সময়ে পুরীর রথের সামনে ভক্তদের নিয়ে বিহ্বল উদ্বাহু চৈতন্যের নামগানের কাহিনি আজও ভক্ত পরিমণ্ডলে মুখে মুখে ফেরে। ইতিহাসবিদ অমিত দে-র মতে, “ভক্তি আন্দোলনের সময়ে রথও এক ধরনের সম্প্রীতির প্রতীক। শিখ বা সুফিদের লঙ্গরের মতো রথও মানুষে মানুষে ফারাক মানে না। তবে আধুনিক যুগে ধর্মের পুনরুত্থানে মানসিকতা পাল্টাচ্ছে। আজকের রথ ক্রমশ পুরুষসুলভ শভিনিজমে (আধিপত্যবাদ) ভরপুর।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement