চুনিমণি দাসীর বাড়ির রথ।-নিজস্ব চিত্র।
রথ মানেই জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি যাত্রা। কিন্তু পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে এই মাসির বাড়ি আসলে জগন্নাথের বান্ধবী ‘পৌর্ণমাসি’-র বাড়ি। কালক্রমে এই ‘পৌর্ণমাসি’ যে কী ভাবে জগন্নাথের মাসি হয়ে গেলেন! সেখানে সাত দিন কাটিয়ে জগন্নাথ যখন মন্দিরে ফেরেন তখন তাঁর অভিমানী স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী তাঁকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেন না। কষ্টেসৃষ্টে জগন্নাথ রসগোল্লা পাঠিয়ে স্ত্রীর মানভঞ্জন করেন। তার পরে মেলে তাঁর মন্দিরে প্রবেশাধিকার।
শ্রীক্ষেত্র পুরীর রথযাত্রার মতোই বাংলার বিভিন্ন স্থানের রথযাত্রা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শ্রীরামপুরের মাহেশ, গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্রের রথের পাশাপশি মহিষাদলের রাজবাড়ির গোপালজিউর রথ প্রসিদ্ধ। পুরনো কলকাতার বাসিন্দা শেঠ-বসাকদের গৃহদেবতা গোবিন্দজির রথযাত্রা ছিল উল্লেখযোগ্য। শোনা যায় বৈঠকখানা থেকে লালদিঘি পর্যন্ত এই রথ টানা হত। কলিকাতার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে প্রাণকৃষ্ণ দত্ত এর উল্লেখ করেছেন। এর পাশাপাশি সেকালে পোস্তার রথও ছিল নাম করা।
সেকালে জানবাজারের রানি রাসমণির বাড়ির রথযাত্রা ছিল বিশেষ আকর্ষণীয়। পুরনো রথটি ছিল রুপোর। সেটি তৈরি করতে সে যুগে খরচ হয়েছিল এক লক্ষ ২২ হাজার ১১৫ টাকা। সেই রথের সঙ্গে ছিল দু’টি সাজানো ঘোড়া, একটি সারথি এবং চারটি পরী। এগুলিও ছিল রুপোর। এই রথযাত্রা শুরু হয় ১৮৩৮ সালে। রথযাত্রা উপলক্ষে সে যুগে যুঁই ফুলের মালা কেনা হত কম করে আড়াই থেকে তিন মণ। আগে জানবাজারের রানি রাসমণির বাড়িতে হলেও এখন এই রথযাত্রা হয় দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে। রানির গৃহদেবতা রঘুনাথ জিউ বেশ কিছু বছর আগে মন্দির চত্বরে রাধাকৃষ্ণের দেবালয়ে স্থানান্তরিত হয়েছেন। সে কালে রানি রাসমণির রথে থাকতেন অসংখ্য মানুষ। ঢাক ঢোল সানাই জগঝম্পের শব্দে চারিদিকে জানান দিয়েই কলকাতার রাজপথে এগিয়ে চলত রথটি। সঙ্গে থাকত নানা রকমের সং।
রামকানাই দত্তের বাড়িতে ধুমধাম করে পালিত হয় রথযাত্রা।
বউবাজার অঞ্চলেই যদুনাথ দত্তের ঠাকুরবাড়িতে গত ১১৯ বছর ধরে সাড়ম্বরে হয়ে আসছে রথযাত্রা। শোনা যায়, যদুনাথ ছোটবেলায় জগন্নাথের পুজো করতেন। পরে তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়ে ঠাকুরবাড়িতে জগন্নাথ প্রতিষ্ঠা করেন। এই পরিবারের গৃহদেবতা জগন্নাথ। এখানে নেই সুভদ্রা ও বলরামের বিগ্রহ। স্নানযাত্রার পরে জগন্নাথ অসুস্থ থাকেন। রথের আগের দিন তিনি নবযৌবন লাভ করেন। সোজা রথ ও উল্টো রথের দিন আজও সুসজ্জিত রথ রাস্তায় বেরোয়। রথ উপলক্ষে রুপোর সিংহাসনে বসানো হয় দেবতাকে। রথের সময় পরিবারের আত্মীয়রা যাঁরা জগন্নাথকে নিমন্ত্রণ করেন তাঁদের বাড়িতে রথ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিশেষ পুজো-ভোগ হয়, একে বলে ‘দ্বারে ভোগ’। সোজা রথের পরের দিন থেকে উল্টো রথের আগের দিন পর্যন্ত বিশেষ পুজো ও ভোগ। হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। থাকে লুচি, ভাজা, ফল, মিষ্টি, দই। রথ উপলক্ষে বসে নহবত। রাজবেশ, পদ্মবেশ, উল্টো রথের দিন ফলের মালা পরানো হয়। উল্টো রথের দিন জগন্নাথ ফিরে আসার পরে রাতে লক্ষ্মীর সঙ্গে মালা বদল করে বিয়ের আচার অনুষ্ঠান পালিত হয়। একে বলে যুগল মিলন।
আরও পড়ুন: রঘুনাথকে কেন্দ্র করেই হয় শান্তিপুরের রথ
বউবাজার অঞ্চলে গোবিন্দ সেন লেনে জগন্নাথ বিগ্রহ ও রথ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চুনিমনি দাসী প্রায় ১২৫ বছর আগে। পাঁচটি চূড়াবিশিষ্ট ত্রিতল এই রথে সাবেক শিল্পরীতির নমুনা দেখা যায়। রথের চার দিকে আছে চারটি পুতুল এবং রথের গায়ে আঁকা আছে দেবদেবীর ছবিও। শোনা যায়, এক বার পুরীর নব কলেবরের সময় অবশিষ্ট এক খণ্ড নিমকাঠ দিয়ে তৈরি হয়েছিল এই পরিবারের নিমকাঠের জগন্নাথ বিগ্রহটি। এই বিগ্রহের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত আছে শালগ্রাম শিলা। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, স্নানযাত্রার পরে হয় বিগ্রহের অঙ্গরাগ। আগে রথের দিন ও উল্টো রথের দিন পথে রথ বেরতো। এখন আর রথ রাস্তায় বেরোয় না। বাড়ির উঠোনেই টানা হয়। রথ উপলক্ষে আজও জগন্নাথের রাজবেশ এবং বামনবেশ হয়। এই সময় প্রতি দিন বিশেষ ভোগও দেওয়া হয়। তার মধ্যে থাকে খিচুড়ি, পোলাও, লুচি, চচ্চড়ি, মালপোয়া, গজা, রসগোল্লা ইত্যাদি। এখনও প্রতি বছর পুরী থেকে পাণ্ডারা আসেন রথ উপলক্ষে।
যদুনাথ দত্তের ঠাকুরবাড়িতে গত ১১৯ বছর ধরে সাড়ম্বরে হয়ে আসছে রথযাত্রা।
মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের মার্বেল প্যালেসে আজও বেলোয়ারি কাচের ফানুসে, রেড়ির তেলে ও মোমবাতির আলোয় গৃহদেবতা জগন্নাথকে রাখা হয়। স্নানযাত্রার দিন থেকেই শুরু হয় উত্সব। প্রথা অনুসারে স্নানযাত্রার পরে জগন্নাথ অসুস্থ হন এবং তাঁকে পাচন দিয়ে সুস্থ করা হয়। এর পরে হয় অঙ্গরাগ। রথের দিন মোট ছ’বার পুজো, চার বার আরতি হয়। রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক প্রচলিত বৈষ্ণব প্রথা অনুসারে আজও চলে সাবেক আচার অনুষ্ঠান। মা লক্ষ্মীর ঘর থেকে আরতি করে রথযাত্রার শুভ সূচনা হয়। এর পরে রথে বসিয়ে জগন্নাথের মূল পুজো হয়। একে বলে ‘দাঁড়ে ভোগ’। এতে থাকে সন্দেশ, ফল ইত্যাদি ভোগ। তার পরে রথের রশিতে টান পড়ে। রথের মহাপ্রসাদের মধ্যে থাকে জগন্নাথবল্লভ, খাজা, গজা, খয়েরচূড়, নিমকি, কটকটি ইত্যাদি। আর ৫৬ ভোগের মধ্যে থাকে সাত-আট রকমের ডাল, ভুনিখিচুড়ি, শাক, নারকেলের পদ, বড়া, বড়ি, ঘণ্ট, ছেঁচকি, পরমান্ন ইত্যাদি। আর থাকে কাসুন্দি ও আচার। এ বাড়ির রথ বাড়ির বাইরে বেরয় না, বাড়ি সংলগ্ন নীলমণি উদ্যানেই টানা হয়। রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে আজও রথের দিন ও উল্টো রথের দিন মেলা বসে।
বউবাজারের রামকানাই অধিকারীর বাড়ির রথ।
দেড়শো বছরেরও বেশি পুরনো বউবাজার অঞ্চলের রামকানাই অধিকারীর রথ। পুরনো সাবেক রথটি আজ আর ব্যবহার করা হয় না। তার পরিবর্তে ছোট একটি রথে বসানো হয় জগন্নাথকে। আগের মতো রথ রাস্তায় বেরোয় না। মন্দিরের মধ্যেই হয় রথযাত্রা। রথের দিন দু’বার রথ টানার প্রথা আছে এ বাড়িতে। সকালে পুজোর পরে এবং পরে সন্ধেবেলা। স্নানযাত্রার পরে জগন্নাথ লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকেন। এই সময় প্রথা অনুসারে তিনি অসুস্থ থাকেন। তাঁকে সুস্থ করার জন্য দেওয়া হয় পাচন। এর পরেই হয় অঙ্গরাগ। তার পরেই রথযাত্রা।