রানাঘাটের সেই স্কুলে কার্ডিনাল। ছবি: শৌভিক দে।
রানাঘাট-কাণ্ডের ব্যাপারে প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে কথা বলবেন খ্রিস্টানদের অন্যতম প্রভাবশালী সংগঠন ‘ক্যাথলিক বিশপস কনফারেন্স অব ইন্ডিয়া’-র সভাপতি কার্ডিনাল ব্যাসিলাস ক্লিমিস। বুুধবার কলকাতায় এসে ওই প্রবীণ সন্ন্যাসী জানিয়েছেন, ঘটনাটির তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে যাওয়ায় দ্রুত বিচার পাওয়ার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। এর আগে রাজ্য সরকারের তদন্তে কার্যত অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন কলকাতার আর্চবিশপ।
বুধবার সকালে দিল্লি থেকে কলকাতায় আসেন ক্লিমিস। এসেই সোজা চলে যান রানাঘাটের সেই কনভেন্ট স্কুলে। সেখানে সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গে কথা বলে, দুষ্কৃতীরা যেখানে তাণ্ডব চালিয়েছিল তা দেখে, যান ‘মাদার সুপিরিয়র’-কে দেখতে। রানাঘাট থেকে বেরিয়ে নবান্নে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে সন্ধ্যায় পার্ক স্ট্রিটে আর্চবিশপের বাড়িতে সাংবাদিক বৈঠক করেন কার্ডিনাল।
কার্ডিনাল বলেন, “কেউ বা কারা ভারতের অসাম্প্রদায়িক পরিবেশকে নষ্ট করতে চাইছে। একে কিছু কিছু সম্প্রদায়ের উপরে আঘাত বলে মনে হলেও আদতে দেশেরই ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের দেশের সংস্কৃতি, চরিত্রের পরিপন্থী।” তবে এই ‘কেউ বা কারা’ বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন, তা স্পষ্ট করেননি ক্লিমিস। তিনি বলেন, “বিভিন্ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। প্রয়োজনে রানাঘাট নিয়েও বলব। তিনি তো প্রধানমন্ত্রী, সকলের দায়িত্বই তাঁর উপরে।”
আদতে কেরলের বাসিন্দা এই কার্ডিনালের সঙ্গে এ দিন কলকাতা ও নদিয়ার একাধিক বিশপ আসেন ওই কনভেন্টে। বিশপস কনফারেন্সের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল ফাদার জোসেফ চিন্নায়ান-ও ছিলেন কার্ডিনালের সঙ্গে। নদিয়ার চাপড়ার এক ফাদার উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “নদিয়া-মুর্শিদাবাদে প্রায় ৬০ হাজার খ্রিষ্টান বাস করেন। নদিয়া জেলায় রয়েছে ১২টি কনভেন্ট স্কুল। আর মুর্শিদাবাদে ৫টি। এই ঘটনার পরে সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তবে আমরা হতাশ হইনি। আশা করি, অভিযুক্তরা দ্রুত ধরা পড়বে।”
এ দিন সকালে রানাঘাট পৌঁছে প্রথমেই কার্ডিনাল সরাসরি ঢুকে পড়েন আক্রান্ত কনভেন্টে। সেখানে তিনি সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গে কথা বলে জেনে নেন শুক্রবার রাতে কী ঘটেছিল। পরে হাসপাতালে অসুস্থ ‘মাদার সুপিরিয়র’-কে দেখে বেরিয়ে কার্ডিনাল বলেন, “কিছু অসামাজিক লোকের কাজ এটা। সন্ন্যাসিনীরা সব কিছু ছেড়ে সামাজিক কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। তাঁদের উপর এই আক্রমণ মানা যায় না।” এই ঘটনাকে তিনি ‘অমানবিক, ঘৃণ্য ও উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করেন।
ঘটনার পরে এলাকার মানুষের প্রতিবাদ আন্দোলন দেখে ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে বিক্ষোভকারীদের নামের ফর্দও তৈরি করে তৃণমূল। কিন্তু এ দিন কার্ডিনাল বলেন, “দলমত নির্বিশেষে যে ভাবে সাধারণ মানুষ এই ঘৃণ্য ঘটনার প্রতিবাদে পথে নেমেছেন, তা শুভ লক্ষ্মণ। ওঁদের সমর্থন জানাতেই এখানে এসেছি।” কনভেন্টে হামলার ঘটনাটি নিছকই ডাকাতির জন্য কি না, সে প্রশ্নও তোলেন কার্ডিনাল। তাঁর প্রশ্ন, “ডাকাতি করতে এসে সন্ন্যাসিনীদের উপরে আক্রমণ কেন, কেনই বা চ্যাপেলের পবিত্র জিনিসগুলিকে তছনছ করা হয়েছে?”
পরে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক সেরে এ দিন সন্ধ্যায় কার্ডিনাল জানান, হাসপাতালে ভর্তি মাদার সুপিরিয়র মানসিক ভাবে যথেষ্ট শক্ত রয়েছেন, দুষ্কৃতীদের ক্ষমাও করে দিয়েছেন। কার্ডিনাল বলেন, “আপাত ভাবে মনে হতে পারে যে এ ধরনের আক্রমণ একটি বিশেষ গোষ্ঠীর উপরে হচ্ছে, কিন্তু আসলে তা হচ্ছে গোটা দেশ ও জাতির উপরে। এমন ঘটনা যতই ঘটুক, খ্রিস্টানদের কোনও ভাবেই সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না।”
সত্তরোর্ধ সন্ন্যাসিনীর উপরে হামলার ঘটনায় রাজ্য বা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরাসরি মুখ না খুললেও রাজ্য সরকারের যে আরও একটু সক্রিয় ও তৎপর হওয়া উচিত ছিল, এ দিন সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন কার্ডিনাল। তাঁর কথায়, “সরকারে যাঁরা আছেন, সকলকে এটা বোঝানো তাঁদের দায়িত্ব যে সকলেই সমান বিচার পাবেন।” তবে এত দিনেও কেউ ধরা না পড়া বা এত দিন পরে সিবিআইকে তদন্ত ভার দেওয়া নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি তিনি। শুধু বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাটির তদন্তভার সিবিআইকে দিয়েছেন। আশা করছি সিবিআই এই ঘটনায় আরও আলোকপাত করবে। আমি আশাবাদী যে তদন্ত স্বচ্ছ ও সচেতন ভাবে হবে এবং দুষ্কৃতীরা ধরা পড়বে।”