শুক্রবার রাত থেকে ডিআইজি অখিলেশ সিংহের নেতৃত্বে সিবিআইয়ের দল বগটুই গ্রামের আনাচ-কানাচ থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান ছাড়াও সে-রাতের ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেছে।
ফটিক শেখের বাড়ির পোড়া রান্নাঘরে ছাইয়ের ভিতর থেকে নমুনা সংগ্রহ করছে ফরেন্সিক দল।
কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটের খোঁজ বিরল নয়, কিন্তু গরু! বগটুই গ্রামের ভস্মস্তূপ খুঁড়তে গিয়ে তারা গরুর খোঁজ, আরও নির্দিষ্ট করে বললে গরু পাচারের সন্ধান পাচ্ছে বলে জানাচ্ছে সিবিআই। বলছে, তদন্তে উঠে আসছে বেআইনি বালি আর পাথর খাদানের তথ্যও। তদন্তকারীদের দাবি, বোঝাই যাচ্ছে, বীরভূমে রামপুরহাটের ওই এলাকায় গরু, বালি ও পাথর পাচার চলত রমরমিয়ে। এবং তৃণমূলের নিহত উপপ্রধান ভাদু শেখই সেই পাচার চক্রের মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন বলে সিবিআইয়ের অভিযোগ। তারা জানাচ্ছে, ওই পাচার চক্রে জড়িত রয়েছে আশপাশের ১৫-১৬টি গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশ। এবং সোনা শেখের সঙ্গে ভাদুর লড়াই ছিল পাচার চক্রের লভ্যাংশের বখরা নিয়েই।
সিবিআই জানাচ্ছে, ভাদু খুন হয়ে যাওয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন তাঁর শাগরেদরা। এক দিকে বছরে কোটি কোটি টাকার মধুভাণ্ড হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আর অন্য দিকে ভাদু খুনের বদলা। এই দু’টির কারণেই বগটুই গ্রামে বেলাগাম আগ্নেয় হামলা হয়েছিল বলে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে অনুমান করছে সিবিআই। তারা জানাচ্ছে, গরু পাচার থেকে আসা বেআইনি টাকা জেলার সর্বস্তরের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে যেত। এক সিবিআই-কর্তা বলেন, “গত কয়েক বছরে পাচার চক্র কী পরিমাণ মুনাফা লুটেছে, ভাদু ও ব্লক সভাপতি আনারুল হোসেনের বাড়ি দেখে সেটা সহজেই অনুমেয়। যদিও বছর ছয়েক আগে ওঁদের এক জন দিনমজুর আর অন্য জন মুরগির মাংসের দোকানে কাজ করতেন।”
আনারুলকে জেরা করে গত ৫-৬ বছরে পাচারের লভ্যাংশের কোটি কোটি কাঁচা টাকা কোন কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে পৌঁছেছে, তা আন্দাজ করা গিয়েছে বলে দাবি তদন্তকারীদের। সিবিআইয়ের এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, ‘‘জেলা পুলিশের একাংশ ও প্রভাবশালীদের যোগসাজশেই যে বীরভূম থেকে গরু পাচার চলত, সেটা আগেই তদন্তে উঠে এসেছে। সেই জন্যই এ রাজ্যের শাসক দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের কাছে চার দফায় তলবি নোটিস পাঠানো হয়েছে।’’
আনারুলকে দফায় দফায় জেরা করা হচ্ছে। সিবিআই সূত্রের খবর, সোমবার জেরার মুখে কান্নায় ভেঙে পড়েন আনারুল। ২১ মার্চ রাতে উপপ্রধান ভাদু শেখ খুন হওয়ার পরে তিনি হাসপাতালে উপস্থিত হন বলে আনারুল তদন্তকারীদের সামনে দাবি করেছেন। আনারুল তদন্তকারীদের জানান, ভাদু খুনের জেরে বগটুইয়ে যাতে কোনও রকম অশান্তি না-ছড়ায়, হাসপাতালে দাঁড়িয়েই তিনি সেই বিষয়ে ভাদু ও তাঁর অনুগামীদের সতর্ক করে দেন। তদন্তকারীরা জানান, সেই সময় তাঁর আশেপাশে কয়েক জন পুলিশ অফিসারও ছিলেন বলে দাবি করেছেন আনারুল। তাই ওই গ্রামে হামলার বিষয়ে আলাদা ভাবে পুলিশকে সতর্ক করার কোনও প্রয়োজন তিনি অনুভব করেননি বলে সিবিআই-কে জানান আনারুল।
সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা জানান, আনারুলের দাবি অনুযায়ী, তাঁর নির্দেশ অমান্য করেই সে-দিন মোটরসাইকেল চালিয়ে ভাদুর অনুগামীরা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায়। প্রাথমিক ভাবে সিবিআইয়ের ধারণা, বগটুই গ্রামে হামলার উদ্দেশ্যেই হাসপাতাল ছেড়েছিল ভাদুর অনুগামীরা। তদন্তকারীদের দাবি, সে-রাতে হাসপাতাল থেকে তিনি স্থানীয় ও জেলা নেতাদেরও ফোনে বগটুইয়ে হামলার আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন বলে জেরায় কবুল করেছেন আনারুল। এক সিবিআই-কর্তা বলেন, “আনারুলের এই দাবি যাচাই করতে রামপুরহাট হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে, সে-রাতে তাঁর পাশে ঠিক কারা ছিলেন।’’
শুক্রবার রাত থেকে ডিআইজি অখিলেশ সিংহের নেতৃত্বে সিবিআইয়ের দল বগটুই গ্রামের আনাচ-কানাচ থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান ছাড়াও সে-রাতের ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেছে। এখনও প্রত্যক্ষদর্শী ও বিভিন্ন সাক্ষীর বয়ান লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে বলে সোমবার জানিয়েছেন তদন্তকারী অফিসারেরা। বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান থেকে তাঁরা জানতে পেরেছেন, সে-রাতে দমকল জ্বলন্ত গ্রামে পৌঁছে গেলেও তাদের জল ঢালতে বাধা দেওয়া হয়েছিল।