ফাইল চিত্র।
ঘটনার বীভৎসতায় পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামের সঙ্গে বীরভূমের বগটুইয়ের তুলনামূলক আলোচনা চলছিল আদালতের আঙিনাতেও। আর ঘটনার তদন্তে হাওড়ার আমতার সঙ্গে মিলে যেতে চলেছে বগটুই বৃত্তান্ত। আমতায় নিজের বাড়িতে অস্বাভাবিক ভাবে মৃত ছাত্রনেতা আনিস খানের দেহ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয় বার ময়না-তদন্ত করেছিল রাজ্য পুলিশ। বগটুইয়েও অগ্নিদগ্ধ একটি বাড়িতে পাওয়া সাত জনের দেহের দ্বিতীয় বার ময়না-তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন জানানোর উদ্যোগ চলছে বলে বুধবারের খবর। পার্থক্য বলতে আনিস কাণ্ডে তদন্তভার এখনও রাজ্য পুলিশের ‘সিট’ বা বিশেষ তদন্তকারী দলের হাতেই আছে এবং বগটুইয়ের ঘটনার তদন্ত করছে সিবিআই।
সিবিআইয়ের একটি সূত্র জানাচ্ছে, বগটুইয়ে সোনা শেখের আগুনে পোড়া বাড়ি থেকে উদ্ধার করা সাত জনের দেহের দ্বিতীয় ময়না-তদন্তের জন্য তারা আদালতে আবেদন করতে পারে। কেন? সিবিআইয়ের বক্তব্য, ওই সাত জনের ময়না-তদন্ত থেকে সুরতহাল, এমনকি শনাক্তকরণ— প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধোঁয়াশা রয়েছে।
তদন্তকারীরা জানান, সোনার বাড়ি থেকে শাবল ও হাঁসুয়া পাওয়া গিয়েছে। ঘরের দেওয়াল থেকে রক্তের নমুনা নিয়েছেন সিএসএফএলের বিশেষজ্ঞেরা। ফলে মৃত্যুর কারণ শুধু যে অগ্নিকাণ্ড, তা মানতে রাজি নয় সিবিআই। তদন্তকারীদের বক্তব্য, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, ২১ মার্চ রাতে গ্রিলের দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে সোনার স্বজনদের উপরে সশস্ত্র হামলা চালানো হয়েছিল। তার পরে বাড়িতে আগুন লাগানো হয়।
কিন্তু দ্বিতীয় বার ময়না-তদন্তের তোড়জোড় কেন? সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের বক্তব্য, ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করার পরে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু ওই চিকিৎসকের বয়ানে তাঁরা সন্তুষ্ট নন। কী ভাবে মৃত্যু হয়েছে, তা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। হামলার পাশবিকতার মাত্রা ঠিক কতটা ছিল, তা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে আদালতে পেশ করা দরকার।
সিবিআই সূত্রের খবর, ২২ মার্চ, বগটুইয়ের তৃণমূল উপপ্রধান ভাদু শেখে খুনের পরের দিন সকালে সোনার বাড়ি থেকে সাতটি মৃতদেহ উদ্ধার করে রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়না-তদন্ত করা হয়। সেই সময় ওই হাসপাতালের ফরেন্সিক বিভাগের প্রধান চিকিৎসক সেখানে উপস্থিত ছিলেন না বলেই তদন্তকারীদের দাবি। তাঁর সহকারী চিকিৎসকেরা ওই সাতটি মৃতদেহের ময়না-তদন্ত করেন। বিকেলে সব মৃতদেহের সুরতহাল এবং শনাক্তকরণের পরে শেষকৃত্য হয়।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে ধোঁয়াশা অনেক। এক তদন্তকারী জানান, আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয়েছে বলে ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ওই সব মৃতদেহে ধারালো অস্ত্রের ক্ষতচিহ্ন ছিল। আগুনে পুড়ে গেলেও ময়না-তদন্তে অস্ত্রাঘাতের ইঙ্গিত পাওয়ার কথা ছিল বলে সিবিআইয়ের অভিমত। সোনার বাড়ি থেকে শাবল ও হাঁসুয়া পাওয়া গিয়েছে। তদন্তকারীদের বক্তব্য, গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই শাবল ও হাঁসুয়া থাকে। কিন্তু সে-রাতের ঘটনায় শাবল ও হাঁসুয়া ব্যবহার করা হয়েছিল কি না, তা জানা প্রয়োজন। দেহ পুড়ে গেলেও হাঁসুয়া বা শাবলের আঘাতের চিহ্নের হদিস ময়না-তদন্তে পাওয়ার কথা। শাবল ব্যবহার করা হয়ে থাকলে যদি হাড়গোড় ভেঙে যায়, ময়না-তদন্তে সেটাও জানা সম্ভব বলে মনে করছেন সিবিআই-কর্তারা।
তদন্তকারীদের অভিযোগ, সাতটি মৃতদেহের ময়না-তদন্তের ভিডিয়ো রেকর্ডিং এখনও পাওয়া যায়নি। আদৌ ময়না-তদন্তের ভিডিয়োগ্রাফি করা হয়েছিল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সিবিআই। তা ছাড়া মৃতদেহের সুরতহাল ও শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে আইনগত নানা ধোঁয়াশা রয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের বক্তব্য, অত্যন্ত দ্রুত ময়না-তদন্ত করা হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। সিবিআইয়ের অভিযোগ, এক ব্যক্তি সব ক’টি মৃতদেহ শনাক্ত করেছেন। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে তিনি সব মৃতদেহ শনাক্ত করলেন, সেই বিষয়েও বিস্তর ধোঁয়াশা রয়েছে।
সিবিআইয়ের খবর, শনাক্তকারী ব্যক্তিকে প্রাথমিক ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁর যে-বয়ান নথিভুক্ত করা হয়েছে, তাতেও ধোঁয়াশা রয়েছে। সেই জন্যই দ্বিতীয় বার ময়না-তদন্তের বিষয়ে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এক সিবিআই-কর্তা।