শিল্পের জন্য। শালবনি পর্যন্ত পদযাত্রার উদ্বোধনে শনিবার সিঙ্গুরের মঞ্চে বুদ্ধদেব। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
বাঙালি হাঁটতে ভালবাসে। সকাল-সন্ধ্যায় তারা পার্কে হাঁটে স্বাস্থ্যের খোঁজে। প্রতিদিন নিয়ম করে লম্বা লম্বা হেঁটে শরীর ফিট রাখেন খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। আরও বহু কারণে হাঁটতে বাঙালির বিরাগ নেই। রাশিয়া বা ভিয়েতনামে বিপ্লব দানা বাঁধলে তারা হেঁটে ফেলে কয়েক কিলোমিটার। নন্দীগ্রামে গুলি বা যাদবপুরে লাঠি চললেও তারা একছুটে রাস্তায়। বই বা গানের জন্য হাঁটতেও তারা পিছপা নয়।
কিন্তু বিশুদ্ধ শিল্পের জন্য পথে নেমে পা মেলানো? গুজরাত, মহারাষ্ট্র পারতে পারে। এ রাজ্য এমন ছবি দেখেনি। শনিবার ঘটে গেল তেমনই ব্যতিক্রমী ঘটনা। সৌজন্যে— রাজ্য বামফ্রন্ট!
যে সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনের হাওয়া নিজেদের পালে টেনে সরকার উল্টে দিয়েছিল তৃণমূল, সেই সিঙ্গুর থেকেই এ দিন শিল্পায়নের বার্তা দিয়ে শালবনির উদ্দেশে পদযাত্রার সূচনা হল। আনুষ্ঠানিক সূচনা করলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। উপস্থিত থাকলেন প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন। কারখানার আদলে তৈরি ট্যাবলোর পিছনে পিছনে প্রথম দফায় সিঙ্গুর থেকে কামারকুণ্ডু পর্যন্ত হাঁটলেন বিমান বসু, মনোজ ভট্টাচার্য, নরেন চট্টোপাধ্যায়, প্রবোধ পণ্ডাদের মতো বাম নেতারা।
এই পদযাত্রা শুরু হল এমন একটা সময়, যার ক’দিন আগেই মিলন মেলায় শেষ হয়েছে ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে দাবি করেছেন, আড়াই লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ তাঁর সরকারের হাতের মুঠোয় এসে গিয়েছে! ওই দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে ঠিকই। কিন্তু শিল্প ছাড়া সামনে এগোনোর পথ নেই, সরকারে সাড়ে চার বছরের পথ পেরিয়ে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতাও যে তার অনিবার্যতা উপলব্ধি করছেন, সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। যে কারণে এ বারের সম্মেলনে পেশাদারিত্বের ছোঁয়া ছিল অনেক বেশি। আয়োজনে ছিল অনেক বেশি যত্নের স্পর্শ। শিল্প ও বণিকমহলের সামনে হাজির হওয়ার মুখে পাছে রাস্তায় কোথাও বাধা পড়ে, তাই সম্মেলন শুরুর আগের রাতটা বহু-তারা হোটেলে কাটিয়েছেন অতীতে এমন বিলাস এড়িয়ে যাওয়া মুখ্যমন্ত্রী।
সম্প্রতি মিলন মেলায় বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটে মুকেশ অম্বানীকে সংবর্ধনা মুখ্যমন্ত্রীর। —ফাইল চিত্র।
সে সম্মেলনের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ‘শিল্প চাই’ প্ল্যাকার্ড হাতে, অ্যাপ্রন পরে দূরপাল্লার মিছিল। তাতে সামিল হাজারে হাজারে মানুষ! সামনে বিধানসভা ভোট। রাজনৈতিক তাগিদ তাই এখন স্পষ্ট হবে সব কর্মসূচিতেই। কিন্তু বিরোধী ও শাসক, দুই শিবিরের অভিমুখ শিল্পের দিকে ফিরছে— এই ইঙ্গিতকে সদর্থক ও স্বস্তিদায়ক মনে করছে সব মহলই!
পদযাত্রার সূচনা করতে গিয়ে বুদ্ধবাবু এ দিন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, শিল্পের পথে সামনে এগোনোই একমাত্র বিকল্প। বিধানসভা ভোটে তাঁরা যে শিল্পকে হাতিয়ার করেই এগোবেন, সেই সুর ব্রিগেড সমাবেশেই বাঁধা হয়েছিল। তাকেই আরও এগিয়ে নিয়ে এ দিন বুদ্ধবাবু বুঝিয়ে দিয়েছেন, শুধু চাষের উপরে নির্ভর করে কেউ এগোতে পারে না। শিল্প অনিবার্য। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের। আমরা জানি, কোন পথে এগোতে হবে। কৃষিকে রেখেই আমাদের যেতে হবে শিল্পের পথে। এগোতেই হবে শিল্পের পথে। কোনও আপস নয়!’’
শিল্পের দাবিতে জমায়েত ও মিছিলে বিপুল উৎসাহ দেখে বাম গণসংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ বিপিএমও-র আহ্বায়ক তথা শ্রমিক সংগঠন সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী পর্যন্ত আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, বিধানসভা নির্বাচনে বামেরা জিততে পারলে সিঙ্গুরে তাঁরা আবার সমাবেশ করবেন কারখানা হওয়ার ঘোষণা করতে! আর ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমানবাবু ডাক দিয়েছেন, ‘‘যারা একের পর এক কারখানায় লালবাতি জ্বালিয়েছে, নবান্নে লালবাতি জ্বালিয়ে তাদের সরাতে হবে!’’
সন্দেহ নেই, সিঙ্গুর থেকে শালবনি সংগঠিত রাজনৈতিক কর্মসূচি। নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের পরে যে মিছিলের সাক্ষী থেকেছে কলকাতা, তাতে কোনও রাজনৈতিক পতাকা না-থাকলেও পরোক্ষে তার রাজনৈতিক প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু তা ছিল একটি নির্দিষ্ট কারণে। বাম আমলেই হলদিয়া প্রকল্পের জন্য পদযাত্রাও নির্দিষ্ট কারণেই। সে দিক থেকে সাধারণ ভাবে শিল্পের জন্য পদযাত্রায় সাধারণ বাঙালির পা মেলানো তাৎপর্যপূর্ণই!
দাবি জানিয়ে অথবা প্রতিবাদে, কোনও ঘটনা বা কারও স্মৃতিতে মিছিল, পদযাত্রা এ রাজ্যে নতুন কোনও ঘটনা নয়। পরাধীন ভারতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মিছিল-পদযাত্রার এমন অনেক নজির দেখেছে এ রাজ্য। স্বাধীনতার পরেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, ট্রাম-বাসের ভাড়া বৃদ্ধি, কিংবা খাদ্যের দাবিতে মিছিল হয়েছে কলকাতা থেকে জেলায়। আটের দশকে কোচবিহার থেকে কলকাতা পর্যন্ত দীর্ঘ পদযাত্রার সাক্ষী থেকেছে এ রাজ্য। ওই সময়েই জঙ্গলমহলের বিভিন্ন জেলার উন্নয়নে কেন্দ্রের কাছে দাবি জানিয়ে পুরুলিয়ার হুড়া থেকে কলকাতা পর্যন্ত পদযাত্রা ছিল আরও এক ইতিহাসের সাক্ষী। আবার রবীন্দ্রনাথের জন্মভূমি জোড়াসাঁকো থেকে কর্মভূমি শান্তিনিকেতন পর্যন্ত দীর্ঘ পদযাত্রাও উপভোগ করেছে বাঙালি। মিছিল হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও।
কিন্তু রাজ্য জুড়ে শিল্পের জন্য সোৎসাহে বাঙালির রাস্তায় নামা— এমনটা মনে করতে পারছেন না প্রায় কেউই! স্বভাবতই আশার আলোও দেখছেন তাঁরা। রাজ্যের শিল্পকর্তা কল্লোল দত্তের মতে, ‘‘বাঙালির এত দিনে বোধোদয় হয়েছে বলে মনে হচ্ছে! অন্তত শিল্প-শিল্প বলছে।’’ অর্থনীতির শিক্ষক অনুপ সিংহের মতে, ‘‘বেটার লেট দ্যান নেভার! বলতে ইচ্ছে করছে, জাগো বাঙালি জাগো!’’ প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থসচিব সুনীল মিত্রের কথায়, ‘‘শিল্পের জন্য বাঙালি রাস্তায় নামলে সাধুবাদ!’’ আবার রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেন বলেন, ‘‘আজকাল সবাই তো শিল্পের কথা বলছে দেখছি!’’
রাজনীতির অঙ্কে অবশ্য শাসক ও বিরোধীকে পরস্পরের প্রতি কটাক্ষ করতে হয়! রাজ্যের শিল্প সম্মেলনকে ‘অশ্বডিম্ব প্রসব’ বলেছে বিরোধীরা। শাসক তৃণমূলও বিরোধী বামেদের শিল্প-যাত্রাকে কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না। সিঙ্গুরের পদযাত্রাকে ‘ভিন্টেজ কার-র্যালি’ বলে বিঁধে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘অপরাধের পরে অপরাধী অকুস্থলে যায়! কিছু ফেলে এসেছে কি না, দেখতে যায়! বুদ্ধবাবুর সিপিএম সিঙ্গুরে তাপসী মালিককে ধর্ষণ করে হত্যার দায়ে যুক্ত দল। সেই হানাদারেরা যতই সিঙ্গুরে যাবে, নেতাইয়ে যাবে, জঙ্গলমহলে যাবে, ততই বাংলার মানুষ এদের দূরে সরিয়ে রাখবে।’’ তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘‘শরীরের মেদ ঝরাতে হেঁটে সিঙ্গুর যাওয়া ভাল। তবে ভুল করেও মানুষের কাছে যাবেন না। কারণ, মানুষ ঝাঁটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আপনাদের জন্য!’’ আর বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, ‘‘সিঙ্গুর নিয়ে যদি ঠিক সময়ে সিপিএম জাগত, তা হলে এই সরকারটাই আসত না!’’