রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়
রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তৃণমূল নেতৃত্বের ‘দূরত্ব’ এখন আর কোনও নতুন বিষয় নয়। এখন জল্পনা, রাজীব কি বিজেপি-তে যোগ দেবেন? রাজীবের শনিবারের বহুঘোষিত এবং প্রচারিত ফেসবুক লাইভ বলছে, বনমন্ত্রী এখনও জল মাপছেন। খানিকটা মচকালেন তিনি। কিন্তু পুরোপুরি কিছু ভাঙলেন না।
মন্ত্রিসভার গত চারটি বৈঠকে যাননি। দলীয় কর্মসূচিতেও অনুপস্থিত থেকেছেন। মাঝেমধ্যেই দলের কাজকর্ম নিয়ে প্রকাশ্যে তির্যক এবং বিরূপ মন্তব্য করছেন। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে গিয়ে দু’বার বৈঠক করেছেন। যাকে ‘শান্তিবৈঠক’ বলেই আখ্যা দেওয়া হচ্ছিল। ফিরহাদ হাকিমও একবার তাঁর সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রাজীবের কণ্ঠে দলীয় সুর ফেরেনি। সে হেন রাজীব যখন ফেসবুক লাইভে আসার দিনক্ষণ ঘোষণা করেছিলেন, তখন জল্পনা ছিল— অতঃপর হয়তো দলের সঙ্গে তৈরি হওয়া দূরত্বের কারণ ব্যাখ্যা করে নিজের আগামী পরিকল্পনা জানান দেবেন বনমন্ত্রী। কিন্তু শনিবারের বারবেলায় তাঁর ফেসবুক লাইভে নতুন কোনও দিশা পাওয়া গেল না। দেখা গেল, এতদিন তিনি যা বলেছেন, এ তারই চর্বিতচর্বণ। তার মধ্যে একটি বাক্য প্রণিধানযোগ্য— ‘‘আমি এখনও ধৈর্য ধরে আছি।’’ যা থেকে এই জল্পনার জন্ম হচ্ছে যে, রাজীবও শেষবেলায় ‘শতাব্দী এক্সপ্রেস’-এর মতো উল্টোদৌড় শুরু করবেন।
ফেসবুক লাইভে একবার রাজ্যের যুব সম্প্রদায়ের ভবিষ্যত্ প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন তিনি। আবার কিছু পরেই বললেন, ‘‘আমাদের দলনেত্রী কাজ করার চেষ্টা করছেন।’’ ডোমজুড়ের বিধায়ক বলেছেন, ‘‘যুবসমাজকে দিশা দেখানোর চেষ্টা করেছি। যুবসমাজ চাইছে, কেউ তাদের পথ দেখাক। বাংলার জন্য আইটি সেক্টর শিল্প করা যায়। রাজ্যে কাজের পরিবেশ তৈরি করা যায়। এখানে যখন দেখি চাকরি নেই, পড়াশোনা হচ্ছে না, বাইরে চলে যাচ্ছে সবাই। খারাপ লাগে। এখানে মেধা আছে। কিন্তু সুযোগ নেই।” আরও বলেছেন, ‘‘আমাদের রাজ্যে যে সম্পদ আছে, মেধা আছে, তা অন্য বহু রাজ্যেই নেই। আমার তাঁদের দেখে খারাপ লাগে। যুবসমাজের অনেকেই বুঝতে পারেন না, কী ভাবে প্রস্তুতি নেবেন। যুব সমাজকে বলব, লক্ষ্যভ্রষ্ট হবেন না।’’
আরও পড়ুন: বঙ্গ বিজেপি-র ‘ফাটল’ নাপসন্দ, ঐক্য প্রদর্শনের নির্দেশ অমিতের
ডিসেম্বরে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। শনিবার রাজীবের অবস্থান নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূলের থেকে কাজ করতে গিয়ে আমি বাধা পেয়েছি। আমার অনেক ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছিল। তাই দল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছি। রাজীবেরও উচিত দল ছেড়ে বেরিয়ে আসা।’’ তবে শুভেন্দুর মন্তব্য প্রসঙ্গে রাজীব বলেন, ‘‘কে কী বলেছে, সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি কী করব, সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।’’ রাজীবের ফেসবুস লাইভ প্রসঙ্গে ফিরহাদের বক্তব্য, ‘‘ফেসবুক লাইভ আবার কী? ক্যাবিনেটের মন্ত্রী যখন, ক্যাবিনেটেই কথা বলুন!’’ তাঁর সম্পর্কে ভুল বোঝানো হচ্ছে বলে রাজীবের অনুযোগ সম্পর্কে তাঁর মন্ত্রিসভার সহকর্মী ফিরহাদের বক্তব্য, ‘‘এখানে থার্ড পার্টি আসবে কী করে! ক্যাবিনেটে যখন কথা হয়, তখন একদিকে মুখ্যমন্ত্রী থাকেন। চারদিকে আমরা। সেই সময় তিনি যা বলেন, আমরা শুনি। বা আমরা যা বলি, তিনি শোনেন। তাই যা বলার রাস্তাঘাটে বলবেন না। মাঝে আবার দোভাষীর দরকার হয় নাকি! আমরা জাপানিতে বলব, আরেকজন বাংলায় অনুবাদ করে মুখ্যমন্ত্রীকে বলবেন! এখানে তেমনকিছু নেই।’’
আরও পড়ুন: বিজেপি-র সঙ্গে ‘ডিল’ রাজ্যে বেকারত্ব ঘোচানোর, দাবি শুভেন্দুর
দল ও তাঁর দূরত্ব প্রসঙ্গে কিছু না বললেও নাম না করে আবার বেশকিছু নেতার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন রাজীব। আবার পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বেশ কয়েকবার ‘আমাদের দলনেত্রী’ বলেও সম্বোধন করেছেন। রাজীব বলেছেন, ‘‘বেশ কিছু নেতা আমার ভাল কাজের অপব্যখ্যা করছে। মানুষ যেখানে চাইবে, আমি সেখানেই থাকব। মাছ যেমন জলে সাবলীল, রাজীব মানুষের মধ্যে সাবলীল।’’ এর পরেই তাঁর সংযোজন, ‘‘দলনেত্রীর আদর্শ আমার আদর্শ ছিল। তাঁর দেখানো পথেই কাজ করে গিয়েছি। কিন্তু অনেক সময় দেখা গিয়েছে, ভুল বোঝানো হচ্ছে বারবার। দলনেত্রীও কাজের কথাই বলেন। কিন্তু যখন কাজ করতে গিয়ে বাধা পাই, তখন খারাপ লাগে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। দুঃখ লাগে যে, কতিপয় নেতা আছে, যখন দিশা দেখাতে চাইছি, তখন তারা সেটার সমালোচনা করছে।”
সম্প্রতি দলের কর্মীদের ‘সম্মান’ নিয়েও সরব হয়েছেন রাজীব। ফেসবুক লাইভেও সেই প্রসঙ্গ টেনে এনে তিনি বলেছেন, ‘‘দলের কর্মীরা শুধু সম্মান চায়। কেউ বলতে পারবেন না, দলের কর্মীরা আমার থেকে অসম্মান পেয়েছে। আমার দলনেত্রীও এই একই কথা বলেন। কিন্তু কখনও দেখা যায় সেই কথা রাখা হয় না। কাজ করতে গিয়ে বাধা পেয়ে মুখ খুলেছি, সেটাকে অন্যায় মনে করি না।’’ আরও বলেছেন, ‘‘আমি এখনও ধৈর্য ধরে আছি। ধৈর্যচ্যুত হইনি। আমার পদের মোহ নেই। মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। অনেক সময়েই ভাল কাজ করতে চেয়ে করতে পারিনি যখন, তখন আহত হয়েছি। ক্ষোভও জমেছে। সেই ক্ষোভ আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি।’’
প্রসঙ্গত, রাজীব হাওড়া জেলা তৃণমূলে একটি ‘প্রভাবশালী’ নাম। কিন্তু হাওড়া জেলা তৃণমূলের অপর প্রবীণ নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ রায়ের সঙ্গে তাঁর সঙ্ঘাত সর্বজনবিদিত। সেই সঙ্ঘাতে দলীয় নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ চেয়েও পাননি বলে আপাতত দলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছেন বনমন্ত্রী। তৃণমূলের একাংশের দাবি, ফেসবুক লাইভেও নাম না করে অরূপকেই নিশানা করেছেন রাজীব।।
ফেসবুক লাইভের শেষপ্রান্তে এসে দলের মৃদু সমালোচনা শোনা গিয়েছে রাজীবের গলায়। তিনি বলেছেন, ‘‘আমার ধ্যান-জ্ঞান সবই মানুষের জন্য। মানুষের স্বার্থে কাজ করতে চাই। ভাল ভাবে কাজ করতে গেলে কিছু নেতা ইচ্ছাকৃতভাবে বাধা দেন। কাজ হয়নি বলেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বলতে হচ্ছে। ভাল কাজ করতে গেলেই বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছি। খানিকটা হলেও সাধারণ মানুষের পাশ থেকে সরে গিয়েছে দল।’’ রাজীব আরও বলেছেন, ‘‘কাজ করতে চাই। তাতে বাধা পেলেই কষ্ট পাই। মনে ক্ষোভ জমে। ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, দলের মঙ্গলের জন্য কথা বলি। দল মানুষের সঙ্গে থাকুক, ভুল থাকলে মিটিয়ে নিক। কাজ করলেই সমালোচনা হবে। প্রতিবন্ধকতা আসবে। কিন্তু ভাল কাজ করার মানসিকতা থাকলে কেউ সরাতে পারবে না।’’
ফেসবুক লাইভ করার পর হাওড়ার পাকুরিয়ায় গিয়েছিলেন রাজীব । তিনি কি তৃণমূলে থাকছেন নাকি বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন? সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে রাজীব জানিয়েছেন, কিছু নেতার জন্য দলের কর্মীরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। কর্মীদের ব্যবহার করে সুবিধা নিচ্ছেন কিছু নেতা। তাঁদের বিরুদ্ধে উচ্চনেতৃত্ব কিছু বলছেন না।
অর্থাৎ, ভাঙলেন না।