মংপুতে রবীন্দ্রনাথের বাড়ি বাঁচাতে উদ্যোগ

রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত ‘সুরেল বাংলো’ বাঁচাতে উদ্যোগী হল মংপুর সিঙ্কোনাক্ষেত্র কর্তৃপক্ষ। ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম মংপুতে এসে এই বাড়িতে ওঠেন। মংপু সিঙ্কোনাক্ষেত্রের আবিষ্কর্তা থমাস অ্যান্ডারসনও ছিলেন এই বাড়িতে। গোর্খা আন্দোলনের সময়ে বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘ অযত্নে পড়ে বাড়িটি এখন ভগ্নস্তূপে পরিণত। বাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণের লক্ষে সম্প্রতি ‘ডিরেক্টোরেট অব সিঙ্কোনা অ্যান্ড আদার মেডিসিনাল প্লান্ট’-এর এক দল পদস্থ প্রতিনিধি অকুস্থলে যান। বিশেষজ্ঞকে দিয়ে সমীক্ষাও করাচ্ছেন ওঁরা।

Advertisement

অশোক সেনগুপ্ত

মংপু শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৬ ১৯:৫৫
Share:

মংপুতে রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত ‘সুরেল বাংলো’।

রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত ‘সুরেল বাংলো’ বাঁচাতে উদ্যোগী হল মংপুর সিঙ্কোনাক্ষেত্র কর্তৃপক্ষ। ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম মংপুতে এসে এই বাড়িতে ওঠেন। মংপু সিঙ্কোনাক্ষেত্রের আবিষ্কর্তা থমাস অ্যান্ডারসনও ছিলেন এই বাড়িতে। গোর্খা আন্দোলনের সময়ে বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘ অযত্নে পড়ে বাড়িটি এখন ভগ্নস্তূপে পরিণত। বাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণের লক্ষে সম্প্রতি ‘ডিরেক্টোরেট অব সিঙ্কোনা অ্যান্ড আদার মেডিসিনাল প্লান্ট’-এর এক দল পদস্থ প্রতিনিধি অকুস্থলে যান। বিশেষজ্ঞকে দিয়ে সমীক্ষাও করাচ্ছেন ওঁরা।

Advertisement

১৯৩৮-এর ২১ মে কালিম্পং থেকে রবীন্দ্রনাথ এই বাড়িতে আসেন। বাইরে ছিল ক্যামেলিয়া গাছ। ওখানেই লেখেন ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি। প্রতিমা দেবীকে ‘কল্যাণীয়াষু বৌমা’ সম্বোধন করে এই বাড়ি সম্পর্কে তাঁর ‘বাবামশায়’, মানে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘‘চমৎকার জায়গা। বাড়িটা তো রাজবাড়ি— স্পষ্ট বোঝা যায় ছিল ইংরেজের বসতি। ঝকঝক করছে। কাঠের মেঝে, আসবাবগুলো পরিষ্কার, উপভোগ্য, উপরে-নীচে ঘর আছে বিস্তর, বিছানা আনার দরকার ছিল না।’’

মংপুতে ব্রিটিশদের তৈরি প্রথম এই বাড়ি চিহ্ণিত হয়েছিল ‘সিরিয়াল ওয়ান’ হিসাবে। তা থেকেই স্থানীয় কথায় ‘সুরেল’। কবে, কে বাড়িটি তৈরি করান, মংপুর বিভিন্ন স্তরে খোঁজ করেও তার সঠিক তথ্য মেলেনি। তবে, প্রায় তিন দশক ধরে সেখানে বিজ্ঞানী হিসাবে কাজ করা মহম্মদ ফজলুল করিম বলেন, ‘‘রয়্যাল বটানিক্যাল গার্ডেনের সুপারের বাংলো হিসাবে ১৮৭০ নাগাদ এটি তৈরি হয়। আশির দশকের মাঝপর্বে সেখানে তৈরি হয় ‘হাই অল্টিচ্যুড রিসার্চ সেন্টার’। এর পর বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।’’

Advertisement

আরও পড়ুন

বসন্তে কীর্তন

এখন কী অবস্থা, তা দেখতে পাহাড়ি রাস্তায় গেলাম তিন কিলোমিটার। উঠতে হল প্রায় দেড় হাজার ফুট। দেখি ভুতুড়ে বাড়ির মত, একতলার কাঠের ছাদ বা দোতলার পাটাতনের একবিন্দু নেই। প্রায় ২৮ ইঞ্চি পুরু দেওয়ালের কাঠামো। পুরোটা আগাছায় ঢাকা। চারপাশ নিস্তব্ধ। থেকে থেকে পাখির ডাক। আশপাশে প্রায় ৬০-৭০ ফুট উঁচু ‘শিশা’ গাছ। পাশের ফাঁকা জায়গায় ‘মাশরুম’ প্রকল্পের অস্থায়ী ছাউনি। লন ছাড়িয়ে পাহাড় নেমেছে ঢাল বেয়ে। তার পর গভীর, গম্ভীর পাইনের বন।

১৯৫৭ থেকে দু’দশকের উপর মংপুর সিঙ্কোনাক্ষেত্রের অন্যতম কর্তা ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে দীর্ঘকাল ছিলেন তাঁর কন্যা সুপর্ণা চক্রবর্তী। বিস্তারিত ভাবে খতিয়ে দেখে তিনি লিখেছেন, ‘‘দোতলা বাংলোটি বিরাট বড়। টানা বারান্দায় টবে টবে জেব্রা গ্রাস, লেমন গ্রাস আর অর্কিডের সারি। বারান্দা পেরিয়ে বিরাট বড় ড্রইংরুম, তার এক দিকে লালচে মেহগনি কাঠের সুদৃশ্য পিয়ানো, অন্য দিকে বসার সোফা আর কাউচ। একতলা-দোতলা মিলে অনেকগুলি ঘর। বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না, ইটালিয়ান মার্বেলের পিরিচ আর বোওল, গ্রীসের চা-দানি, রোমের অনবদ্য ফুলদানি আর অনন্য সাধারণ সব অ্যান্টিকে গোটা বাংলোটি ছিমছাম ভাবে সাজানো।’’

১৮৫৫ নাগাদ সিঙ্কোনা এল নীলগিরি পাহাড়ে। মাদ্রাজ সরকার কারখানা তৈরি করে সেখানে। ১৮৬০-এ লাট-গৃহিনী লেডি ক্যানিং এ রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চলে সিঙ্কোনা চাষের আদর্শ ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে কলকাতার রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুপার থমাস অ্যান্ডারসনকে ডেকে দায়িত্ব দেন। ১৮৬১তে শুরু হয় পাইলট প্রকল্প। ১৮৭৩-’৭৪ সালে চালু হয় পুরোদস্তুর চাষ। কিন্তু ইতিমধ্যে কালান্তক ম্যালেরিয়া কেড়ে নিয়েছে লেডি ক্যানিং এবং অ্যান্ডারসন— দু’জনকেই।

‘ডিরেক্টোরেট অব সিঙ্কোনা অ্যান্ড আদার মেডিসিনাল প্লান্ট’-এর অধিকর্তা স্যামুয়েল রাই বলেন, ‘‘বাড়িটি সংরক্ষণের ব্যাপারে জিটিএ বা সরকারের কেউ সক্রিয় হলে অর্থ মঞ্জুরের ব্যাপারে উপকার হত। কিন্তু কেউ হননি। এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা।’’ আশপাশে বন দফতরের জায়গা আছে। ওরা সে কারণে বাড়িটি নিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। তিনি এ কথা জানিয়ে বলেন, ‘‘আমরা চাই বাড়িটিকে ঘিরে একটা পর্যটন কেন্দ্র তৈরি হোক। তবে, সংস্কারের ব্যাপারে একটা সমস্যা, বাড়ির ভিতরের ছবি মেলেনি। আমরা তা-ও অভিজ্ঞ স্থপতিকে দিয়ে সমীক্ষা করাচ্ছি।’’

এই সংরক্ষণের ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা নিতে চান মংপুর সিঙ্কোনাক্ষেত্রের তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিরেন লামা-ও। তিনি বলেন, ‘‘ওটা আমাদের সম্পদ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যাকে তা জানিয়েছি। লোকসভা ভোটে প্রার্থী বাইচুং ভুটিয়ার সঙ্গেও বাড়িটি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেছিলাম।’’

অধিকর্তা স্যামুয়েল রাই বলেন, ‘‘বাড়িটি সংরক্ষণে অর্থ দরকার। জিটিএ কর্তৃপক্ষর সঙ্গে কথা বলব। বাড়িতে নাকি ৫২টা দরজা ছিল। ছিল কাঠের মেঝে। সে সব করাতে গেলে প্রচুর কাঠ লাগবে। গাছ কাটতে হবে। এ কারণে আমাদের পর্যায়ক্রমে নিতে হবে পরিবেশ ও বন দফতরের প্রয়োজনীয় অনুমতি বা ছাড়পত্র। এ সব শুরু করব।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement