তিন ছাত্রকে বহিষ্কারের দাবিতে বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় কার্যালয় চত্বরে শিক্ষার্থীদের জমায়েত। বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীর তোলা ছবি।
অন্দর-বাইরে চাপের মুখে বিশ্বভারতী অবশেষে শনিবার ছাত্রীর যৌন হেনস্থার অভিযোগ দায়ের করল বোলপুর থানায়। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অভিযুক্ত তিন ছাত্রকে গ্রেফতার করল পুলিশ। প্রাথমিক তদন্তের পর যৌন নির্যাতন, প্রকাশ্যে বিবস্ত্র করা, মারধর, গুরুতর আঘাত, কর্মস্থলে যৌন হেনস্থা প্রভৃতির ধারা দিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে খবর, রাতেই ওই তিন ছাত্রের শারীরিক পরীক্ষা করতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। ধৃত অরিন্দম গিরি এবং মাসুম আসিক মোল্লা কলাভবনের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, অনিরুদ্ধ কর্মকার তৃতীয় বর্ষের। পুলিশ জানিয়েছে, এই ঘটনায় আরও এক জনের নাম রয়েছে অভিযোগে। বোলপুরের বাসিন্দা ‘অরুণ’ নামে ওই ব্যক্তি বিশ্বভারতীর সঙ্গে যুক্ত নয়।
গত মঙ্গলবার কলাভবনের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী অধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করে, তার তিন সিনিয়র সহপাঠী তার উপর একাধিক বার যৌন নির্যাতন চালায় এবং তার অশ্লীল ছবি মোবাইলে তুলে তাকে ‘ব্ল্যাকমেল’ করে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করেনি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। ওই ছাত্রীর বাবা শুক্রবার সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, তাঁকে মিডিয়া বা পুলিশের কাছে মুখ না-খোলার জন্য চাপ দিয়েছেন বিশ্বভারতীর শীর্ষ কর্তারা। নিরাপত্তার অভাবে ওই ছাত্রীর বাবা মেয়েকে নিয়ে শান্তিনিকেতন ছাড়েন। এর পরেই প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ।
শুক্রবার উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্ত দাবি করেন, বিশ্বভারতীর তরফে কোনও গাফিলতি হয়নি। যৌন নিগ্রহ প্রতিরোধের জন্য সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত ‘বিশাখা কমিটি’ ওই অভিযোগের তদন্ত করছে। এ দিন বিশ্বভারতীর তরফে বিকেল চারটে নাগাদ একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, ‘বিশাখা কমিটি’ ওই ছাত্রদের প্রাথমিক ভাবে অপরাধী বলে রিপোর্ট দিয়েছে। তার সুপারিশ মেনে ওই ছাত্রদের সাসপেন্ডও করা হয়। বিশ্বভারতীর ছাত্র পরিচালক হরিশ্চন্দ্র মিশ্র শনিবার দুপুর ১২টা নাগাদ পুলিশে এফআইআর করেন। বিশ্ববিদ্যালয়েরই অন্য সূত্রে অবশ্য খবর, ভিন্রাজ্যের ছাত্রীর উপর যৌন নির্যাতনের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেতে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চেয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় চিঠি পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। তাই তড়িঘড়ি শনিবার পুলিশের দ্বারস্থ হল বিশ্বভারতী।
চাপ তৈরি হয়েছে বিশ্বভারতীর অন্দরেও। এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ প্রায় দু’শো ছাত্রছাত্রী মিছিল করে বিশ্বভারতীর উপাচার্যের দফতর এবং কলাভবনের অধ্যক্ষকে স্মারকলিপি দেন। তাঁদের দাবি, অভিযুক্ত তিন ছাত্রকে বহিষ্কার এবং পুলিশে ফৌজদারি মামলা করতে হবে। সরব হয়েছেন প্রাক্তনীরাও। ‘বিশ্বভারতী অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন’ থেকে পদত্যাগ করেছেন ওই সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট বর্ষণজিৎ মজুমদার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ড থেকে তিনি ফোনে বলেন, “বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ ওই ছাত্রীকে পুলিশে যাওয়া থেকে যদি নিরুৎসাহ করে থাকে, তা হলে ন্যায়বিচারের পথে বাধা তৈরি করা হয়েছে। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনও নিরপেক্ষ কমিটি দিয়ে এ বিষয়ে তদন্ত করা হোক।” তাঁর বক্তব্য, যে হেতু প্রাক্তনীদের সংগঠনটির সদস্যরা নির্বাচিত নন, বিশ্বভারতীর কর্তৃপক্ষ দ্বারা মনোনীত, তাই তিনি সেখান থেকে পদত্যাগ করে তদন্তের দাবি করছেন।
বিশ্বভারতীরই একটি অংশের বক্তব্য, “কর্তৃপক্ষ যেটুকু নড়ে বসেছেন, তা কেবল সংবাদমাধ্যম এবং কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ মন্ত্রকের চাপের মুখে পড়ে। না হলে এটুকুও ওঁরা করতেন না।” দার্জিলিঙের সাংসদ বিজেপি নেতা এস এস অহলুওয়ালিয়া একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ওই ঘটনাকে ‘ভয়ানক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “দার্জিলিং এবং লাগোয়া এলাকার বহু ছাত্রছাত্রী বিশ্বভারতীতে পড়তে যায়। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ ওই ছাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। আমার কাছে এই তথ্যও রয়েছে যে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে ছাত্রী এবং তাঁর অভিভাবকের কথা যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে শোনেন না কর্তৃপক্ষ।” বিষয়টি মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নজরে আনবেন বলে জানান অহলুওয়ালিয়া। নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে এ দিন বিজেপি বোলপুর শহরে এবং ভুবনডাঙা এলাকায় মিছিল করে।
বিশ্বভারতীতে রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি তথা কংগ্রেস নেতা সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “কলাভবনে যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।”
নানা মহল থেকে চাপ থাকায় এ দিন পুলিশও ছিল তৎপর। বেলা ১২টা নাগাদ বিশ্বভারতীর তরফে অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরেই দুপুরে ছাত্র পরিচালকের দফতরে যান বোলপুরের এসডিপিও সূর্যপ্রতাপ যাদব, বোলপুরের আইসি দেবকুমার রায় এবং শান্তিনিকেতন তদন্ত কেন্দ্রের আইসি অশোক সিংহ মহাপাত্র। সেখান থেকে বেরিয়ে তাঁরা কথা বলেন বিশাখা কমিটির সভাপতি মৌসুমী ভট্টাচার্যের সঙ্গে। সূর্যপ্রতাপ যাদব বলেন, “বিশ্বভারতী কিছু কাগজপত্র আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে।” জেলা পুলিশ সূত্রে খবর, অভিযুক্তদের মোবাইলও তুলে দেওয়া হয় পুলিশের হাতে। তাতে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ এসএমএস মিলেছে।
বিশ্বভারতীতে নির্যাতনের অভিযোগ করে নানা সময়ে বেশ কিছু ছাত্রী শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে গিয়েছেন। ২০০৪ সালে সঙ্গীত ভবনের এক মার্কিন ছাত্রী বিশ্বভারতীর পিয়ার্সন মেমোরিয়াল হাসপাতালে এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার লিখিত অভিযোগ জানিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি তদন্তও শুরু করে। কিন্তু মাঝপথেই ওই ছাত্রী বিশ্বভারতী ছেড়ে চলে যান। গত বছর মণিপুরের এক ছাত্রী পল্লিশিক্ষা ভবনের এক ডিনের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেন। এ ক্ষেত্রে বিশ্বভারতীর তদন্ত কমিটির সুপারিশে ওই ব্যক্তিকে শুধু ডিন পদ থেকে সরানো হয়। ছ’মাস আগেই কলাভবনের ভাস্কর্য বিভাগের শেষ বর্ষের এক ছাত্রী অভিযোগ করেন, সেখানকার এক অধ্যাপক দু’বছর ধরে যৌন হেনস্থার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি ওই অধ্যাপককে কলাভবন থেকে বদলি করে কেবল। বিভিন্ন মহলের দাবি, ছাত্রীদের যৌন হেনস্থার অভিযোগকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দেওয়ার ইতিহাস বিশ্বভারতীতে রয়েছেই। কলাভবনের ঘটনা প্রমাণ করল, সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে।