বিভিন্ন অংশে ক্ষয় ধরেছে ইলামবাজারের হাটতলা এলাকার টিনের ছাউনি দেওয়া টেরাকোটা মন্দিরের।
ইদানিং রাজনৈতিক সংঘর্ষের জেরে বারবার খবরের শিরোনামে এসেছে বীরভূমের ইলামবাজার। কিন্তু তারও বহুদিন আগে থেকেই বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির চর্চায় এই গঞ্জের নাম সুবিদিত। কেন না, এখানে যেমন রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন বহু টেরাকোটা মন্দির, এই ইলামবাজার হয়েই এক সময় বণিকেরা দূরদূরান্ত থেকে সংলগ্ন অজয় দিয়ে পালতোলা নৌকায় মালপত্র নিয়ে যাতায়াত করত। বণিকদের আসা-যাওয়ায় সেদিনের এই গঞ্জ ছিল মুখরিত। বণিকদের কাল কবেই হারিয়ে গিয়েছে। অজয় এখন বছরের বেশিরভাগ সময় শুকিয়ে কাঠ। প্রশাসনের উদাসীনতায় ও সংরক্ষণের অভাবে ইলামবাজারের শতাব্দী প্রাচীন পুরাকীর্তিগুলির এখন ভগ্ন দশা। সে সব পুরাকীর্তির ভগ্নদশা নিয়ে উদ্বিগ্ন এলাকার সংস্কৃতি-কর্মীরা।
“মানুষের ইতিহাস সচেতনতার অভাবে এই জেলায় কত মন্দির যে ধ্বংস হয়েছে বা হচ্ছে তার হিসাব নেই। ইলামবাজারেও ব্রাহ্মণ পাড়ায় লক্ষ্মী জনার্দন নারায়ণ মন্দির ও শিব মন্দিরটি সংরক্ষণে সরকারকে আরও উদ্যোগ নিতে হবে।” এই আক্ষেপ ইলামবাজার হাইস্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক সৌরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের।
বোলপুর-দুর্গাপুর জাতীয় সড়ক অজয় নদের তীরে এক সময়ের গঞ্জ ইলামবাজার এখন বড় শহরের পথে হাঁটছে। দিন দিন বাড়ছে তার পরিধি। এই গঞ্জের যে ইতিহাস বলছে, সপ্তদশ শতাব্দীতে বণিকদের আনাগোনা ও ব্যবসা বাণিজ্যের ফলে অজয় তীরবর্তী অঞ্চলগুলি হয়ে ওঠে সমৃদ্ধশালী। একে একে গড়ে উঠেছিল বাজার সমন্বিত গ্রাম। ওই গ্রামগুলি এখন ইলামবাজারের ভিতর বেশিরভাগই অন্তর্ভূক্ত। যেমন, শুকবাজার, ভগবতীবাজার, গৌরবাজার।
ইলামবাজারে নানা পুরাকীর্তির জন্য এবং এখানকার মানুষের পুরাকীর্তির প্রতি আগ্রহের কারণেই বীরভূম তথ্য সংস্কৃতি দফতরের তত্ত্বাবধানে ইলামবাজারে একটি আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা বিষয়ে আলোচনা সভা হয় ২০০৪ সালে।
সে সভায় আশপাশের বহু হাইস্কুল ও মাদ্রাসার ইতিহাসের শিক্ষক শিক্ষিকারা এসেছিলেন। সৌরেন্দ্রবাবুর দেওয়া তথ্যে জানা যায়, সেই সভাতেই ঠিক হয় ইলামবাজারে একটি আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। ওই চর্চাকেন্দ্রের নামে রেজিস্ট্রেশনও নেওয়া হয়েছে। সৌরেন্দ্রবাবুর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকেন্দ্র ভিত্তিক রাঢ় ভাবনা নামে একটি লিটল ম্যাগাজিনও।
কিন্তু কারা নির্মাণ করলেন এত মন্দির? ইলামবাজারের প্রবীণ সংস্কৃতি কর্মী আদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পাশ্চাত্য বণিক জন চীপের সহযোগী এ্যারিস্কিন সাহেবের মাধ্যমে নীল ও লাক্ষার ব্যবসা করে অনেকেই সম্পদ শালী হয়ে উঠেছিলেন এই এলাকায়। তাঁদের অন্যতম হল দত্ত, বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি বংশীয়রা। মূলত তাঁরাই তৈরি করেছিলেন কিছু মন্দির।”
সংরক্ষণের পরে ব্রাহ্মণ পাড়ার লক্ষ্মী জনার্দন নারায়ণ মন্দির।
এলাকার মন্দিরগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইলামবাজার হাটতলায় আটকোণাকৃতি ও ছ’কোণা টিনের ছাউনি বিশিষ্ট মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দের টেরাকোটার মন্দির। ব্রাহ্মণ পাড়ায় লক্ষ্মী জনার্দন নারায়ণ মন্দির ও শিব মন্দিরটিও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। লক্ষ্মী জনার্দন নারায়ণ মন্দিরের উপরে পাঁচটি গম্বুজ রয়েছে। মন্দিরের গায়ে দেবদেবীর প্রতিকৃতি ছাড়াও ইংরেজ সাহেবদের, মেম সাহেবদের এবং টুপি পড়া ইংরেজ সেনাদের প্রতিকৃতি রয়েছে। শিব মন্দিরের গায়ে বড় আকারের জগদ্ধার্থী ও দুর্গার প্রতিকৃতি রয়েছে। বীরভূমের অন্যতম লোকসংস্কৃতির গবেষক ও শিক্ষক আদিত্য মুখোপাধ্যায় বলেন, “মন্দিরের গায়ে যে টেরাকোটার কাজগুলি হয়েছে, বীরভূমের আর কোনও মন্দিরে এত কাজ নেই।”
এ সবের অনেকগুলিই এখন সরকারি উদাসীনতায় ভেঙে পড়ছে। রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে হাটতলার টিনের ছাউনির মন্দিরটির টেরাকোটার কাজ অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কথিত রয়েছে, একবার অজয় নদে নুন ভর্তি পাল তোলা নৌকা নদের চড়ে আটকে গিয়েছিল। তখন এক সন্ন্যাসী একাই হাত দিয়ে ঠেলে নৌকাটি চলাচলের ব্যবস্থা করে দেয়। তখন লবন ছিল যথেষ্ট মহার্ঘ্য জিনিস। ওই সন্ন্যাসীর কথা মতো লবন বণিকেরা কয়েক বস্তা লবণ ওই মন্দিরে পাঠিয়ে দেয়। তখন থেকেই ভালো কাজের জন্য মানুষেরা এই মন্দিরে মহাপ্রভূর কাছে নুন মানত করে।
প্রতিবছর এখানে চব্বিশ প্রহরের কুঞ্জ পালা কীর্তন ও নগর পরিক্রমা হয়। সেই উপলক্ষে এখানে মেলাও বসে। ওই কয়েকদিন বহু জায়গা থেকে বহু মানুষ লবনের ভোগ দিয়ে আসে নিত্যানন্দকে। সেই লবন বিক্রি হয় আট থেকে দশ হাজার টাকায়।
কী ভাবছে প্রশাসন? ইলামবাজারের বিডিও প্রলয় সরকার বলেন, “মন্দিরগুলির কথা জানি। সংরক্ষণের কাজ দরকার কোথাও কোথাও। এটা পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের কাজ। আগের বিডিও-রা তাঁদের সে সব নিয়ে জানিয়েছেন।”
ছবি: বিশ্বজিত্ রায়চৌধুরী।