ভেঙে পড়েছে শ্যামবাটি সেতু। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
যানজট, ফুটপাথ দখল, যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা দোকান-বাজারের সমস্যা নিয়ে এমনিতেই নাভিশ্বাস বোলপুরের। তার উপর পৌষমেলার আগে শহরে ঢোকার সেতুগুলির বেহাল দশা ভাবিয়ে তুলেছে খোদ প্রশাসনকেই। শ্যামবাটির সেচ সেতুটি ভেঙে পড়ায় শহরে ঢোকার অন্য বেহাল সেতুগুলি নিয়ে ঘোর চিম্তায় যেমন তাঁরা, আতঙ্কিত বাসিন্দারাও!
বোলপুরে আসা-যাওয়ার পথে কম করে ছ’টি সেতু পার হতে হয়। বর্ধমান জেলা থেকে অজয় নদ পার হয়ে ঢোকার জন্য যেমন রয়েছে অবন সেতু, সিউড়ির দিক থেকে শহরে ঢোকার মুখে ময়ূরাক্ষী সেচ ক্যানেলের উপর রয়েছে তিনটি সেতু। এই তিনটির মধ্যে শ্যামবাটির সেতুটি আগেই চাপ সহ্য করতে না পেরে ভেঙে পড়েছে। চিপকুটি এবং বিজয়া ব্যাঙ্কের সামনের সেতু দুটির অবস্থাও ভালো নয়। একইসঙ্গে যানজটে নাজেহাল রেলপুল-লালপুল। স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের কথায়, শহরে লাইফলাইন দাঁড়িয়ে আছে এই সমস্ত সেতুর উপরই।
পাড়ুই-এর ধানাই মোড় ধরে কসবা হয়ে আসার পথে মাস দুয়েক আগে শ্যামবাটির সেচ সেতুটি ভেঙে পড়ার পর, বোলপুর-শান্তিনিকেতনের বহু মানুষ অসুবিধায় পড়েছেন। অন্যদিকে সাঁইথিয়া, লাভপুর রাস্তা ধরে বোলপুরে ঢোকার মুখে প্রান্তিক পার হয়ে যে বড় ক্যানেল সেতুটি রয়েছে, চাপ বেড়েছে সেটির উপরে। প্রান্তিক থেকে মকরমপুর রাস্তার ওপর থাকা সেচ দফতরের এই সেতুটির অবস্থা আরও ভয়ানক বলছেন বাসিন্দারা। তাঁদের আশঙ্কা, ইদানিং কালে গাড়ির যাতায়াত বেড়েছে। যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে সেতুটি।
ঘটনা হল, দিনের পর দিন ওই সেতুর ওপর দিয়ে মাল বোঝাই, পাথর বোঝাই গাড়িগুলি আসা-যাওয়া করছে। ফলে স্থায়িত্ব কমার পাশাপাশি, একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে সেতুর অংশ। প্রান্তিক উপনগরীর বাসিন্দা চম্পাবতী লোহার বলেন, “এই রাস্তার ওপর দিয়ে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে স্কুলে দিতে যাই। বোলপুরে গিয়ে বাজার হাট সারতে হয়। ওই সেতু পেরোনোর সময়ে মনে হয় এই বুঝি ভেঙে গেল।”
শান্তিনিকেতন লাগোয়া সেচ ক্যানেলের সেতুটি ভেঙে পড়ায় বিপদে পড়েছেন বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ। ওই রাস্তার ওপর নির্ভরশীল কয়েক হাজার মানুষ প্রতি নিয়ত চরম হেনস্থার মুখে পড়ছেন। বিপদে পড়েছেন দেশ বিদেশের পর্যটকরাও। এ দিকে নানুর, কীর্ণাহার, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া জেলা থেকে আসার পথে শহরে ঢোকার মুখে সঙ্কীর্ণ সেতু লালপুলে আকছার যানজট লাগছে ইদানিং। কেন না, শ্যামবাটির সেতু ভাঙার পর থেকে বেশিরভাগ গাড়ি বিজয়া ব্যাঙ্কের সামনের সেতু পার হয়ে লালপুল হয়ে শহরে ঢোকে। মেলার আগে, যানজটের এই চিত্র দেখে বিপদের আশঙ্কা করছেন বাসিন্দারা। দ্রুত বিপজ্জনক সেতুগুলি সংস্কারের দাবি উঠেছে এলাকায়।
বেসরকারি সংস্থার এক কর্মী, স্থানীয় বাসিন্দা পিনাকী সরকার বলেন, “বাড়ি থেকে টুরিস্ট লজ মোড়ে কর্মস্থলে আসতে হয় শ্যামবাটি পেরিয়ে। কখনও আবার মকরমপুর হয়ে। শ্যামবাটির দিকে সেতু ভেঙে গিয়েছে। আবার মকরমপুরের দিকে বড় ক্যানেলের সেতু যে কোনও সময়ে ভেঙে যাবে, এই আশঙ্কায় ভুগছি।” কার্যত পিনাকীবাবু কিংবা চম্পাবতী লোহারদের মতো অনেকেই সেতু নিয়ে সঙ্কটে পড়েছেন। কাউকে ঘুরপথে শহরে ঢুকতে হচ্ছে, তো কাউকে যানজটে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। তাঁদের প্রশ্ন, বোলপুরে সেতুর সঙ্কট মিটবে কবে?
সঙ্কীর্ণ বড় সেচ ক্যানাল সেতু।
স্কুল পড়ুয়া ইমতিয়াজ খান, আদালতের কর্মী মনোরমা দাস কিংবা রিকশা চালক নিতাই দাসদের দাবি, অবিলম্বে সংস্কার করা হোক ভগ্ন এবং বিপর্যস্ত অবস্থায়ে থাকা সেতুগুলি। বাসিন্দাদের অসুবিধার কথা অবশ্য অস্বীকার করেননি বোলপুরের মকরমপুরের তৃণমূলের এক নম্বার ওয়ার্ড কাউন্সিলার মণিমালা বটব্যাল। তিনি বলেন, “বাসিন্দাদের অসুবিধার কথা মাথায় রেখে আমরা সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে, যাতে দ্রুত ওই সেতু সংস্কার হয় তার জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি।”
বস্তুত, শ্যামবাটি সেচ সেতু এবং বড় ক্যানেলের সেচ সেতুটি শুধু মাত্র সেচ দফতরের কাজকর্ম দেখভাল করার জন্য ব্যবহার করার কথা। এবং সেই উদ্দেশ্যে সেতুগুলির তৈরি হয়েছে। কিন্তু ওই রাস্তার ওপর দিয়ে এবং আশেপাশে ঘন জনবসতি ও জনপদ গড়ে ওঠায়, ওই সমস্ত সেতুর ওপর চাপ বাড়ে। শুধু তাই নয়, ৬৫-৭০ টন ওজনের পাথর বোঝাই এবং মালবাহী গাড়িগুলি আহরহ আসা যাওয়া করায় সেতুর ভগ্ন দশা হয়েছে।
সাহেবগঞ্জ-লুপ লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সংকীর্ণ রেলসেতু লালপুল নিয়ে সমস্যা যদিও আজকের নয়। সেতু সংস্কারের জন্য দফায় দফায় বৈঠক করা হয়েছে রেল মন্ত্রকের উদ্যোগে। কিন্তু মন্ত্রিত্ব বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেই ফাইলও গতি হারিয়েছে। তৃণমূল পুরপ্রধান সুশান্ত ভকত বলেন, “পৌষমেলা তো জাতীয় উৎসবের চেহারা নিয়েছে। তাই মেলার পরে সকল স্তরের সঙ্গে বৈঠক করে বিকল্প রাস্তার কথা নিয়ে আলোচনা হবে। ইতিমধ্যেই রেল ওই সেতু সংস্কারের জন্য ১৩ কোটি ৫৬ লক্ষ থাকা বরাদ্দ করেছেন। দ্রুত কাজ শুরু হবে।”
কিন্তু সেচ ক্যানেলের সেতু নিয়ে কি বলছে ময়ূরাক্ষী সাউথ ক্যানেল ডিভিশন? কবেই বা বড় ক্যানেল সেচ সেতুর সংস্কার হবে?
ময়ূরাক্ষী সাউথ ক্যানেল ডিভিশনের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার সঞ্জয় সিংহ বলেন, “শ্যামবাটি সেচ সেতু সংস্কারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই ভগ্ন সেতুর পাশ দিয়ে অস্থায়ী ভাবে পারাপারের ব্যবস্থা করা হয়েচে। শুরু হয়েছে সেতু সংস্কার। পাশাপাশি বড় ক্যানেল সেচ সেতু নিয়েও, আমরা প্রস্তাব পাঠিয়েছি। অনুমোদন পেলে, দফতরের নিয়ম মেনে প্রয়োজনীয় সংস্কারে হাত দেওয়া হবে।”