ভেঙে গিয়েছে স্টেডিয়ামে ওঠার সিঁড়ি। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
ন’য়ের দশকে আইএফএ খেলার কথা মনে আছে? রাজ্য যুব ক্রীড়া উৎসব? মোহনবাগান অ্যাকাডেমি, পিয়ারলেস অথবা রাজ্য মহিলা ফুটবল দলের খেলা? সে সময় এমন সব হাই-প্রোফাইল দলের খেলা হত যে মাঠে, বোলপুর শহরের সেই মাঠের স্টেডিয়ামের এখন ভগ্ন দশা। বলা ভাল, বোলপুরের সেদিনের স্টেডিয়াম এখন বিপজ্জনক নির্মাণ!
রাজ্যের হাতেগোনা কয়েকটি স্টেডিয়ামের ভিতর এই স্টেডিয়ামটি ছিল অন্যতম। যেমন সুদৃশ্য গ্যালারি, তেমনই ছিল খেলা ও খেলোয়াড়দের জন্য সবরকমের সুবন্দোবস্ত। মাঠে আন্ডারগ্রাউন্ড জল নিকাশি ব্যবস্থা যেমন ছিল, উত্তম যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল এই স্টেডিয়ামে। ক্লাবগুলির কথায়, কোনও খেলার জন্য যা যা প্রয়োজন, এখানে তার সবই ছিল। এলাকার ক্লাবগুলির সহযোগিতা, ক্রীড়ামোদী মানুষদের সক্রিয় যোগদান এবং এলাকায় শরীরচর্চা এবং খেলার মান্নোয়নের জন্য, সমস্ত রসদ মজুত ছিল এখানে। কিন্তু দিন যত এগিয়েছে, একের পর এক বিভাগে উন্নয়ন হওয়া তো দূরের কথা, স্টেডিয়ামের দৈন্যদশা প্রকট হয়েছে। জাতীয় মানের খেলা এখন ইতিহাস!
স্টেডিয়ামের স্মৃতিতে মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার কর্তা ব্যাক্তি এবং ক্রীড়াবিদদের গলার সুর নেমে আসে। কেন না, তাঁদের অনেকেই জেলার মধ্যে এই স্টেড়িয়ামে খেলার জন্য এবং প্রতিযগিতায় যোগ দেওয়ার জন্য একসময় মুখিয়ে থাকতেন। সংস্কারের অভাবেই এখন যার ভগ্নদশা। তাঁদের আশঙ্কা, অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।
বাম জমানায় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আমলে ১৯৮৩ সালে এই স্টেডিয়াম তৈরি হয় বোলপুরে। যদিও সে সময়, কয়েকটি হাতেগোনা খেলার জন্য শহরের প্রাণকেন্দ্র ডাকবাংলো মাঠ সংলগ্ন জায়গাটিকে নষ্ট না করার আর্জি জানানো হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। কিন্তু সরকার তাতে আমল দেয়নি। বোলপুরের প্রাক্তন পুরপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কৃষ্ণপদ সিংহ রায় বলছিলেন সে কথা। তিনি বলেন, “শহরের এক মাত্র প্রাণকেন্দ্র ডাকবাংলো মাঠকে ১৯৫৭ সাল নাগাদ ‘ডাকবাংলো মাঠ হস্তান্তর প্রতিরোধ কমিটি’ গড়ে বাঁচিয়ে ছিলাম ছাত্রজীবনে। ১৯৮৩ সালে যখন এই স্টেডিয়াম করার কথা বলা হল, তখন আমি বোলপুর পুরসভার পুরপ্রধান। আমরা চেয়েছিলাম এই জায়গা নষ্ট না করে, হরেকরকমের খেলার জন্য স্পোর্টস কমপ্লেক্স করা হোক, শহর লাগোয়া সুবিস্তীর্ণ জায়গায়। বিরোধিতা টেকেনি।”
কৃষ্ণপদবাবুরা সে সময় চাননি স্টেডিয়াম হোক। কিন্তু ওই জায়গাতেই স্টেডিয়াম হয়েছে। এখন তিনি স্টেডিয়ামের বেহাল দশা দেখে বলছেন, “একটি সম্পদ যখন গড়ে তোলা হয়, তার তো উপযুক্ত রক্ষণবেক্ষণ করতে হয়। দুঃখ হচ্ছে দেখে, এরকম একটি স্টেডিয়াম অচিরে ধ্বংস স্তূপে পরিণত হচ্ছে।”
অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেল শহরের আরোও অনেকের কথাতেও। স্টেডিয়ামে ঢোকার মুখেই যে কারোও নজর যাবে গ্যালারির দিকে। কেন না, একদিকে ঝড়ে পড়ছে সিমেন্টের চাঁই। বসার আসনের অবস্তাও বেহাল। কোনও কোনও জায়গায় লোহার রেলিং ভেঙে পড়েছে। ঘেরা স্টেডিয়ামের লোহার ফেন্সিং কাটা নানা জায়গায়। সেই ফাঁক গলেই ভিতরে বসে নেশার ঠেক। চারশো আসন বিশিষ্ট গ্যালারির ঢালাই নষ্ট হওয়ায় জল চুঁইয়ে পড়ছে নিচের হল ঘরগুলিতে। গার্ডওয়াল গুলির অবস্থাও বেহাল। তালা দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় ক্রমশই সমাজবিরোধীদের আড্ডা স্থল হয়ে পড়ছে ঘরগুলি।
স্টেডিয়ামের মাঠে যাঁরা নামেন, তাঁরা কি বলছেন? বোলপুর মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক তাপস কুমার দে বলেন, “সংস্কার আর পুনরুদ্ধারের অভাবে একটি আন্তর্জাতিক স্তরের মাঠ যেমন হয়, বোলপুর স্টেডিয়ামের অবস্থাও তাই। বোলপুর পুরসভার সহায়তায়, কোনও রকমের জোড়া তালি দিয়ে, খেলাগুলি পরিচালনা হচ্ছে। তবে সংস্কার ও পুনরুদ্ধারের জন্য সংশ্লিষ্ট সব স্তরে আবেদন জানানো হয়েছে। কিন্তু হচ্ছে কই?”
মাঠে ঢুকলেই বোঝা যায়, কি বেহাল দশা মাঠের। যত্রতত্র বিপজ্জনক গর্ত। যে কোনও সময়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। প্রায় ভেঙে পড়েছে আন্ডারগ্রাউণ্ড জল নিকাশির ব্যাবস্থা। মাটিতে ঢাকা পড়ে রয়েছে, নিকাশি নালা ব্যবস্থাও। ফলে জল জমে মাঠে। পুরুষ ও মহিলাদের জন্য দুটি শৌচাগারের ব্যবস্থা থাকলেও, তা ব্যবহারের অযোগ্য। খেলোযাড়দের বিশ্রাম নেওয়া বা পোশাক বদলানোর জায়গায় নেই। যে নলকূপটি রয়েছে, সেটিও ব্যবহারের অযোগ্য। নেই বিদ্যুতের সংযোগও।
নিজের সংসদীয় এলাকায় খেলাদুলোর মানোন্নয়ন, শরীর চর্চা, সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সম্পদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বরাবরই উদ্যোগী হতে দেখা গিয়েছে লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। এলাকার কবিগুরু ক্রীড়াঙ্গন, গীতাঞ্জলি সংস্কৃতি অঙ্গনের মতো সম্পদ এই এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে, তাঁরই উদ্যোগে। স্টেডিয়ামের বর্তমান অবস্থার কথা শুনে হতাশ তিনিও। তিনি বলেন, “ওই মাঠের আন্ডারগ্রাউন্ড জল নিকাশির ব্যবস্থার জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। খুব দুঃখ হচ্ছে, এত সুন্দর একটা স্টেডিয়াম পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে দেখে। আমার তো মনে হয় না এই এলাকার মানুষজনের খেলার প্রতি ভালবাসা রয়েছে।”
বোলপুর পুরসভার উদ্যোগে এবং অর্থানুকুল্যে স্টেডিয়ামের পাশে ১৪টি আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘটনা হল, এখন যে খেলাগুলি পরিচালনা করা হচ্ছে, সেগুলি পুরসভার উদ্যোগে অনেকটা চলে। কিন্তু সংস্কার? পুরপ্রধান সুশান্ত ভকত বলেন, “পুরসভার ক্ষমতা অল্প। তার মধ্যে থেকে কাজ করি আমরা।”
পদাধিকার বলে বোলপুর মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি মহকুমাশাসক এবং অন্যতম সহ-সভাপতি মহকুমা পুলিশ আধিকারিক(এসডিপিও)। এলাকার মানুষ বলছেন, গোটা বিষয়টি দেখভালের জন্য মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার দাবী তুলছেন। তাঁরা জানান, জেলার অন্য দুই স্টেডিয়ামের পরিচালনার দায়িত্ব সিউড়ি ও রামপুরহাটের মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার হাতে রয়েছে। ফলে সংস্কার এবং পুনরুদ্ধারের জন্য কোনও আর্থিক বরাদ্দ পেতে গেলে ব্যক্তিগত স্তরে এবং সংস্থাগত দিক থেকে অসুবিধে হয় না। কিন্তু বোলপুরে ওই দায়িত্ব না থাকার ফলে, অনেকে সময়ে ওই আর্থিক বরাদ্দের জন্য তদ্বির করতে অমনোযোগী হতে হয় সংশ্লিষ্ট কর্ম কর্তাদের।
স্টেডিয়াম সংস্কারের জন্য সরকারের দু’কোটি টাকার আর্থিক অনুদান পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ওই আবেদনের কাগজ পত্র লাল ফিতের ফাঁসে আটকা পড়েছে রয়েছে।
হদিশ পাচ্ছে না, খোদ মহকুমা ক্রীড়া সংস্থাও। কী বলছেন মহকুমাশাসক? মহকুমাশাসক তথা বোলপুর মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি মলয় হালদারের আশ্বাস, “সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”