রুদ্ধ পথ। জাতীয় সড়কে, দুবরাজপুরের পাহাড়েশ্বরের কাছে তোলা নিজস্ব চিত্র।
একেবারে ভিতর দিয়ে যাওয়া দু’টি রাস্তাই এই শহরের ‘লাইফ লাইন’। আবার ও দু’টিই যত নষ্টের গোড়া!
প্রাচীন গঞ্জ থেকে ধীরে ধীরে শহরে রূপ নেওয়া দুবরাজপুর দিন দিন আরও রুদ্ধ হয়ে পড়ছে যানজটে। আর তার জন্য শহরের মধ্যে দিয়ে যাওয়া অপ্রশস্ত ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক ও রাজ্য সড়ককেই (ঠাকুর সত্যানন্দ রোড) দুষছেন বাসিন্দারা। আর দু’টি রাস্তাই ক্রমে সরু হয়ে আসার পিছনে উঠে আসছে অবৈধ দখলদারির অভিযোগ। তারই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন চলাচল। এবং শহরের বুকে কোনও বাসস্ট্যান্ড না থাকা। সব মিলিয়ে যত দিন এগিয়েছে, দুবরাজপুর যেন যানজটের শহরের চেহারা নিয়েছে। অথচ কোনও আমলেই পুরসভা বা জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে সমস্যা দূর করা নিয়ে কোনও উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। যে ভাবে রাস্তা দখল করে দোকান, বসতবাড়ি উঠত, ভারী গাড়ি দাঁড় করিয়ে ব্যবসায়ীদের পণ্যখালাস কিংবা যে কোনও স্থানে বাস দাঁড়িয়ে পড়ে যাত্রীদের তোলানামা চলত, সে ছবি আজও পাল্টায়নি। অন্তত এমনটাই দাবি শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের।
এই তো দিন কয়েক আগেই শহরের মধ্যে জাতীয় সড়কে দু’টি ভারী গড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছিল। ওই দুর্ঘটনার জেরে টানা ৮ ঘণ্টা যানজটে রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল গোটা শহর। ছোটবড় পথ দুর্ঘটনা লেগেই রয়েছে সেখানে। যানজটে নাকাল পথচারী, নিত্যযাত্রী, স্কুলপড়ুয়া থেকে সাধারণ মানুষ। এই অবস্থা মুক্তির পথ একটাই। বাসিন্দারা বলছেন, শহর এড়িয়ে বাইপাস তৈরি করা হোক। প্রায় ৪০ বছরের পুরনো এই পুরশহরের এটা দীর্ঘ দিনের দাবি। বাসিন্দাদের ওই দাবি ন্যায্য বলে মেনে নিয়েছে পুরসভাও। কিন্তু পুরবাসীদের ক্ষোভ, এত কিছুর পরেও শহরকে যানজট থেকে নিস্তার দিতে বাইপাস তৈরির ব্যাপারে পুরসভা বা প্রশাসন, দু’ তরফেই তেমন কোনও উদ্যোগ দেখতে পাওয়া যায় না।
পুরসভা সূত্রের খবর, ৪০ হাজারেরও বেশি জনসংখ্যা বিশিষ্ট এই শহরের আয়তন যথেষ্টই (১৬.৮৪ বর্গ কিমি)। পুরশহরের তকমা পাওয়ার আগেই শহরের মূল দু’টি রাস্তা ও বাজার এলাকাকে কেন্দ্র করেই ধীরে ধীরে কলেবরে বেড়ে উঠেছে প্রাচীন এই গঞ্জ। পরিকল্পনার অভাব ও প্রশাসনের নজরদারি এড়িয়ে বহু মানুষ রাস্তা দখল করেই বাড়ি বা দোকান তৈরি করেছেন। পুরসভা তৈরির পরেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং ভোটবাক্সের বাধ্যবাধকতা সেই প্রবণতাকে থামাতে পারেনি বলেই অভিযোগ। যানজট কমাতে অবৈধ দখলদারি যেমন তোলা হয়নি, তেমনই শহরের জন্য বাসস্ট্যান্ড গড়ে তুলতেও কাউকে ভূমিকা নিয়ে দেখা যায়নি। আবার যে অল্প কয়েকটি বিকল্প রাস্তা রয়েছে, উপযুক্ত সংস্কারের অভাবে সেগুলিও চলাচলের অনুপযুক্ত হয়েছে। ক্ষমতায় বাম-ডান, যে দলই থাকুক, সব আমলেই এক জিনিস ঘটতে দেখেছেন শহরের প্রবীণ বাসিন্দারা।
২০০৬ সালে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের তকমা পায় রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম রাজ্য সড়কটি। রাস্তাটি দুবরাজপুর পাহাড়েশ্বরের গা ঘেঁষে পোদ্দারবাঁধ হয়ে পুরসভা, দুবরাজপুর থানা, আদালত, কামারশাল মোড়, ইসলামপুর, পাওয়ার হাউস মোড় দিয়ে গিয়েছে। জাতীয় সড়কে উন্নীত হওয়ার পরে রাস্তায় যানবাহনের চাপ কয়েকগুন বেড়ে যায়। কিন্তু রাস্তা চওড়া করা হয়নি। দু’ধার ঘেঁষে থাকা বাড়ি বা দোকান আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকায় রাস্তাটি কোথাও কোথাও এতটাই সঙ্কীর্ণ যে দু’টি ভারী গাড়ি পাশাপাশি যাওয়ার সময় প্রায় দিনই যানজট তৈরি হয়। অন্য দিকে, শহরের ঠিক মাঝ বরাবর দিয়ে গিয়েছে দুবরাজপুর-বক্রেশ্বর রাজ্য সড়কও। সমস্যার চিত্রটা এখানেও এক। পাওয়ার হাউস মোড়, কামারশাল মোড় হয়ে দুবরাজপুর বাজার সংলগ্ন পাকুড়তলা মোড়ে এসে প্রায় দিনই গতি অবরুদ্ধ হয়ে যায়। ফলে যানজটে প্রায়ই নাকাল হতে হয় পুরবাসীকে। বিশেষ করে স্কুলে যাতায়াতের সময়। দুবরাজপুর নাগরিক সমিতির সম্পাদক তথা এলাকার চিকিৎসক শ্যামাপ্রসাদ মিশ্রের অভিযোগ, “পুরসভার এই সমস্যা বহুদিন। বাম বোর্ড বা ডান বোর্ড কাউকেই সেই সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তরিক হতে দেখিনি। বহুবার এ বিষয়ে দরবার করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা মেটানোর ব্যাপারে কোনও অগ্রগতি হয়েছে বলে শুনিনি।”
বাম আমলের পুরপ্রধান মধূসূদন কুণ্ডু শহরের এই সমস্যা নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। অন্য দিকে, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য এখনকার তৃণমূল বোর্ড এবং গত এক দশক ধরে চলা কংগ্রেস পরিচালিত পুরবোর্ডকেই দায়ী করছেন সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সাধন ঘোষ। তাঁর দাবি, “দুবরাজপুর-বক্রেশ্বর রাস্তার জন্য আশ্রম মোড়-সাতকেঁদুরী দিয়ে একটি বাইপাস রাস্তা বাম আমলেই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পুরবোর্ড ও প্রশাসনের দিক থেকে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা চলার অযোগ্য হয়েছে। তাঁর আরও দাবি, জাতীয় সড়কে উন্নীত হওয়ার আগে শহরে যানবাহনের বৃদ্ধি দেখে দুবরাজপুর থেকে গ্রামীণ হাসপাতাল যাওয়ার রাস্তার ডান দিকে একটি বাসস্ট্যান্ড তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে ঠিক ভাবেই বিভিন্ন রুটের বাসও থামছিল। উদ্দেশ্য ছিল, দুবরাজপুরের পাওয়ার হাউস মোড় থেকে পাহাড়েশ্বরের কাছাকাছি মূল রাস্তার সংযোগকারী একটি বাইপাস রাস্তা তৈরি করা। সাধনবাবু বলেন, “ভবিষ্যতে শহরবাসীর নাকাল হওয়ার আশঙ্কা করেই আমরা এই পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে বেশ খানিকটা এগিয়েও গিয়েছিলাম। কিন্তু ক্ষমতা হারানোর পরে পরবর্তী বোর্ড সেই ভাবনা বাস্তবায়িত করেনি।” উল্টে বাইপাসের জন্য চিহ্নিত ফাঁকা জায়গা এখন অনেকটাই বসতিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। অবহেলায় পড়ে রয়েছে বাসস্ট্যান্ডটিও। বর্তমান রাজ্য সরকারের জমিনীতির জন্য শহরের যানজট দূর করতে ফলপ্রসূ ওই পরিকল্পনা আর সম্পন্ন করা হবে না বলেই তাঁর আশঙ্কা।
সমস্যার গুরুত্ব স্বীকার করে নিলেও তৃণমূল পুরপ্রধান অবশ্য সিপিএম নেতা বা নাগরিক সমিতির দাবি মানতে নারাজ। পীযূষবাবুর দাবি, “বাইপাসের দাবি নিয়ে বহুবার জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। জেলা প্ল্যানিং কমিটির মিটিংয়েও আলোচনা হয়েছে। তবে, বাইপাস কবে হবে, এ বিষয়ে কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত নেই।” তিনি জানান, আশ্রম মোড়-সাতকেঁদুরী বাইপাস গত বছরই সারানো হয়েছে। তবে, তাঁর দাবি, “ওই রাস্তা সারানোর ব্যাপারে আমাদের ফান্ড নেই। রাজ্য পূর্ত সড়ক দফতর রাস্তাটির দায়িত্ব নিতে পারে। সে ব্যাপারে কথা চলছে। যে পথগুলি অসময়ে ব্যবহার করা যাবে, সেগুলিও মেরামত করা হবে।” বাম আমলে তৈরি বাসস্ট্যান্ডটিকে ‘নির্বাচনী চমক’ জানিয়েই খারিজ করেছেন তিনি। যদিও এ নিয়ে এত দিনেও কেন কোনও বিকল্প ভাবনা তৈরি হল না, তা নিয়ে তাঁর কাছ থেকে কোনও সদুত্তর মেলেনি।
পুরসভার তহবিল না থাকা নিয়ে পীযূষবাবুর এই দাবি আবার নয়া বিতর্ক খাড়া করেছে। বিরোধীদের অভিযোগ, বর্তমান তৃণমূল পুরবোর্ড উৎসব, অনুষ্ঠানে যে টাকা খরচ করছে, তার ছিটেফোঁটাও যদি উন্নয়নমূলক কাজে লাগানো যেত, তাহলে শহরের চেহারাই বদলে যেত। পুরসভার একমাত্র সিপিএম কাউন্সিলর শেখ আলাউদ্দিনের মন্তব্য, “পুরসভায় দামি সিসিটিভি লাগানোর সময় এই পুরবোর্ড লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতে পারে। আবার ইফতার পার্টি, শিক্ষক দিবসের মতো অনুষ্ঠানেও অনায়াসে আরও কয়েক লক্ষ টাকা উড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু রাস্তা সংস্কারের মতো প্রাথমিক উন্নয়নমূলক কাজের বেলাতেই ওরা ‘ফান্ড নেই’ বলে রব তোলেন। আমার বিশ্বাস পুরসভায় সিসিটিভির চেয়ে বেহাল রাস্তা সংস্কার অনেক বেশি জরুরি।” এই ভাবনা নিয়ে চললে শহরের যানজট সমস্যা দূর করার বিষয়েও কোনও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত পুরবোর্ড নিতে পারবে বলেই ওই সিপিএম কাউন্সিলরের আশা।
এ দিকে, রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের দায়িত্বে থাকা এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র নীরজ সিংহ বলছেন, “পুরসভা মৌখিক ভাবে বাইপাসের দাবি জানিয়েছে। বিষয়টি আমাদের সমীক্ষা বিভাগ দেখে। তারা সমীক্ষা চালিয়েছে। কিন্তু কী সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটা তারাই বলতে পারবে।” যদিও তিনি জানিয়েছেন, অদূর ভবিয্যতে গোটা রাস্তাটাই চারলেনের করার একটা পরিকল্পনা হচ্ছে। তাঁর আশা, “তখন বাইপাস না করে আর কোনও উপায় থাকবে না। কারণ, শহরের মধ্যে দিয়ে ওই রাস্তা করতে গেলে অনেক বাড়ি ভাঙা পড়বে।”