যমুনা পুকুরে চলছে ঘটে জল ভরা। —নিজস্ব চিত্র
বোধন দিয়ে শুরু হল দুবরাজপুরের বালিজুড়ি গ্রামের রায় ও চট্টোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজো। কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে (যা দুর্গাপুজোর নবমী থেকে ঠিক এক পক্ষ কাল আগে) বোধনের মাধ্যমে মা’কে জাগিয়ে দুর্গাপুজো শুরুর এই রীতি শতাব্দী প্রাচীন। বুধবার সকালে চোখে পড়ল তেমনই দৃশ্যে। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ গ্রামের ওই দুই পরিবার যমুনা পুকুর থেকে শোভাযাত্রা সহকারে মঙ্গলঘট ভরে প্রতিষ্ঠিত দুর্গা মন্দিরে নিয়ে আসার পর শুরু হল পুজো। এমনিতে সপ্তমীর সকালে গ্রামের সব পারিবারিক দুর্গাপুজোর নবপত্রিকা স্নানের জন্য শোভাযাত্রা সহকারে আনা হয় যমুনা পুকুরেই। বোধনের দিন অনেকটা একই ছবি ধরা পড়ে।
কেন বোধনের চল? সেটা স্পষ্ট করে জানাতে পারেননি দুই পরিবারের প্রবীণ সদস্যেরা। তবে প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে রায় পরিবারের এবং সাড়ে তিনশো বছর ধরে চট্টোপাধ্যায় পরিবারে এমনই রেওয়াজ চলছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। বর্তমানে রায় পরিবারের দুর্গাপুজোর দায়িত্ব বিমল রায়ের। অন্য দিকে, চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজোর শরিক ৬০টি পরিবার। এ বার দায়িত্ব পেয়েছেন রাসবিহারী মুখোপাধ্যায়।
দুই পরিবারের পক্ষ থেকে দুর্গাপুজোর ইতিবৃত্ত তুলে ধরলেন এক শরিক মনোরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক ৭৫ ছুঁইছুঁই মনোরঞ্জনবাবুই শোনাচ্ছিলেন দুই পরিবারের দুর্গা পুজোর কথা। বললেন, “এক সন্ন্যাসীর নির্দেশে রায় পরিবারের পূর্বপুরুষ নীলকন্ঠ রায় চারশো বছরের বেশি আগে পুজোর শুরু করেছিলেন। ওঁর একমাত্র মেয়ে পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল গ্রামেরই চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পূর্বপুরুষ রামদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বিয়ের পরই রামদেবের এক বন্ধু হরিহর মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে দুর্গাপুজো শুরু করেন। সেই সময় রাজনগরে মুসলিম রাজাদের শাসনকাল চলছে। রামদেবের ছেলে তেকুরাম চট্টোপাধ্যায় বড় হয়ে রাজনগরের মুসলিম রাজা আলিনকি খানের দেওয়ান হন। তেকুরাম নিজের ছেলে কাশীনাথের অন্নপ্রাসনে রাজাকে নিমন্ত্রণ করলে বালিজুড়ির বাড়িতে আসেন রাজা আলিনকি। ছোট কাশীনাথকে মুড়ি ও মাছ ভাজা খাওয়ার জন্য ছ’টি পুকুর এবং ৮০ বিঘা সম্পত্তি দিয়ে যান। তেকুরাম ছেলের বদলে দুর্গার নামে সেই সম্পত্তি লিখে নেন।” তিনি আরও জানালেন, সালটা বাংলা ১১১১। সম্পত্তি পাওয়ার পর অবস্থা ফিরলে প্রতিমা তৈরি করে পুজো শুরু হয় চট্টোপাধ্যায়দের পরিবারে। যেহেতু রায় পরিবারে বোধন থেকেই দুর্গাপুজোর চল শুরু হয়েছিল সেই রেওয়াজ চট্টোপাধ্যায়দের পরিবারও মেনে চলতে শুরু করে। এখনও পর্যন্ত ১১ পুরুষ ধরে চলতে থাকা পুজোর নিয়মের নড়চড় হয়নি। বরং পুজো কলেবরে বেড়েই চলেছে।
রায় পরিবারের বিমল রায়, এবং চট্টোপাধ্যায় পরিবারের প্রধান পুরোহিত সত্যরাম চট্টোপাধ্যায়রা মঙ্গলঘট নিয়ে মন্দিরে আসার পরই দু’টি মন্দিরে একই ভাবে শুরু হল পুজো। সন্ধ্যায় আরতী। এ দিন শরিকদের বাড়িতে রান্না বন্ধ। কারণ, বোধন উপলক্ষে মধ্যাহ্ন ভোজনের আয়োজন করে দুই পরিবারই। গ্রামের মানুষজনকেও প্রসাদ দেওয়া হয়। তবে আয়োজনের নিরিখে এগিয়ে চট্টোপাধ্যায়দের পুজো। বধূ শোভারনি চট্টোপাধ্যায়, অনিমা মুখোপাধ্যায়, শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়রা বললেন, “আজ থেকেই শুরু হল দুর্গাপুজো। বছরের এই সময়টার অপেক্ষায় থাকি সারা বছর। শরিকদের প্রত্যেক পরিবারের যাঁরা বাইরে থাকেন পুজোর ঠিক আগে তাঁরাও অসবেন। এক পরিবারের মতো আনন্দে পুজোর কয়েকটা দিন কেটে যায়। বোধনের দিন ছাড়াও পুজোর তিনদিনও রান্না বন্ধ সকলের ঘরে। চলে প্রসাদ খাওয়া। আর চুটিয়ে আনন্দ করা।”