ভিড়ে ঠাসা পথ। শহরের গুরুত্বপূর্ণ চৌরাস্তা মোড়ে প্রতিদিনের দৃশ্য। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
সময় সকাল ৯টা।
গণদেবতা এক্সপ্রেস সবে স্টেশন ছেড়েছে। স্টেশন মোড়ে তখন সার দিয়ে গাড়ি। রয়েছে অগুণতি রিকশা, ভ্যানও। যার নিট ফল, কাশিমবাজার, কাছারিপট্টি রাস্তা, বাইপাস থেকে শহরে ঢোকা টাউন সার্ভিস বাস, শান্তিনিকেতন রোড থেকে স্টেশন এবং উল্টো পথে আসা-যাওয়া করা দু’চাকার বাইক, সাইকেল আরোহী সব কিছুই থমকে গিয়েছে। এরই মধ্যে চলছে সঙ্কীর্ণ রাস্তার পাশেই থাকা স্ট্যান্ডগুলি থেকে ক্রমাগত সাইকেল ও মোটরবাইকের আনাগোনা। কুণ্ডলীকৃত এই জটে রাস্তায় ফেঁসে দাঁড়িয়ে পড়েছে রোগী নিয়ে বর্ধমানগামী অ্যাম্বুল্যান্সও। তীব্র স্বরে সাইরেন বাজিয়েও এগোতে পারছে না এক ইঞ্চিও। কেউ কাউকে জায়গা ছাড়তে নারাজ। কথা কাটাকাটি, বচসা থেকে মারধরের জোগাড়। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন, নীরবে আস্ত একটি প্রদর্শনী চলছে! মিনিট পনেরো পরে অবশ্য যানজট থেকে কিছুটা মুক্তি মেলায় গাড়ি চলতে শুরু করল। অবশ্য দু’মিনিট পেরোতে না পেরোতেই ফের একই অবস্থা।
বোলপুর শহরে যানজট-যন্ত্রণার এটাই প্রতিদিনের দৃশ্য। এর বাইরে শান্তিনিকেতনের বারো মাসে তেরো পার্বণ আছে, এলাকার মন্ত্রী-প্রতি মন্ত্রীদের কনভয় আছে, শহরের দোল-দুর্গোৎসব আছে! কিন্তু অভিযোগ, সব জেনেও দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই পর্যটনকেন্দ্রের রাস্তা প্রশস্ত করা কিংবা যান নিয়ন্ত্রণ, এ সব নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের কোনও নজরই নেই।
শান্তিনিকেতন ও তাকে কেন্দ্র করে নিত্য গজিয়ে ওঠা নানা রির্সট যত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, শহর বোলপুর থমকে যাচ্ছে ততই যানজটের জটে। শহরে আগের তুলনায় ভিআইপিদের আনাগোনাও বেড়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কনভয়ও বোলপুরে এখন দেখা যায় ফি হপ্তায়। কিন্তু শহরের যানজট নিয়ে হেলদোল নেই কোনও নেতা-মন্ত্রীরই। আর পুলিশ? স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা বলছে, বিশ্বভারতীর উৎসব অথবা হেভিওয়েট মন্ত্রী শহরে এলেই যান নিয়ন্ত্রণের তৎপরতা বাড়ে পুলিশের। আর বছরের বাকি দিনগুলো সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের চিত্র সেই একই থাকে।
শুধু স্টেশন মোড় নয়, বোলপুরের চৌরাস্তা মোড়, নিচুপট্টির রাস্তা, থানার সামনের রাস্তা, মসজিদ রোড, শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন রোড, কাছারিপট্টির রাস্তাও এখন দিনের বেশির ভাগ সময় থমকে থাকে। স্কুল, কলেজ পড়ুয়া, হাসপাতাল যাওয়ার মানুষজন, সকলে কার্যত নিরুপায়! রাস্তায় নিত্য যানজটে ভোগান্তি এবং নাজেহাল হওয়ার ছবি শহরের আরও কয়েকটি জায়গাতেও রয়েছে। প্রতিনিয়ত হেনস্থা এবং দুর্ভোগ পোহাতে হয় রেলপুল ও লালপুলে। অভিযোগ, এই শহরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত পুলিশ কর্মীই নেই। হাতেগোনা কয়েক জন পুলিশ কর্মী এবং পুরসভার কয়েক জন অস্থায়ী স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে শহরে যান নিয়ন্ত্রণের ভার থাকে।
শহরজুড়ে এই যানজটের কারণ?
পুলিশ-প্রশাসনের দিক থেকে শিথিল ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ তো রয়েইছে। সেই সঙ্গে দায়ী স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের ট্রাফিক নিয়ম-কানুন নিয়ে উদাসীনতাও। এর সঙ্গে রয়েছে বোলপুরের সাবেক কালের অপরিসর রাস্তা-ঘাট। পরিকল্পনাহীন ভাবে শহর বেড়েছে, রাস্তা বাড়েনি। গোটা শহরে সরকারি উদ্যোগে গাড়ি পার্ক করার কোনও নির্দিষ্ট স্থান নেই। ফলে রাস্তার ধারে দোকানের সামনে গ্রাহকদের ইতস্তত রাখা সাইকেল, রিকশা, মোটরবাইক এমনকী চার চাকা গাড়ি পর্যন্ত অবৈধ ভাবে পার্ক করা থাকে। কোথাও ফুটপাতেও তৈরি হয়েছে দোকান। শহরের বেশির ভাগ প্রধান রাস্তার ওপরই রোজ দোকান খুলে বসেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। চিত্রা মোড় যাবার পথে, শিবতলার কাছাকাছি এলাকায় ফুটপাথ দখল করে থাকা আস্ত একটি শাক সব্জির বাজার বা, চিত্রা মোড়, চৌরাস্তা থেকে স্টেশন রোডের দু’পাশে রয়েছে সেই নজির। বোলপুর ব্যাবসায়ী সমিতির সম্পাদক সুনীল সিংহ বলেন, “ফুটপাথ দখল করে ব্যবসা বাণিজ্য যাঁরা করে আসছেন, তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক। আমরা যানজট মুক্তিতে সব রকমের সহায়তা করব।”
বোলপুরে যানজটের অন্য একটি কারণ, শহরের আশেপাশের গ্রামগঞ্জ থেকে প্রতিদিন চিকিৎসা করাতে, বাজার করতে, সিনেমা দেখতে এবং পড়াশোনার জন্য মানুষজন আসেন। প্রতিদিন বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ শহরের ছবিটা আরও মারাত্মক হয়। এক দিকে সুপারফাস্ট ট্রেন শান্তিনিকেতন আসে হাওড়া থেকে। ওই ট্রেন থেকে নেমে গন্তব্যে যাওয়া এবং ওই ট্রেন ধরে হাওড়া যাওয়ার জন্য কার্যত রোজ ঝামেলা বাধে শহরের প্রতিটি মোড়ে। যানজটের জেরে হেনস্থার মুখোমুখি হন দেশ- বিদেশ থেকে শান্তিনিকেতন আশ্রম দেখতে আসা পর্যটকেরাও। যানজটে জেরবার হয়ে ক্ষুব্ধ এলাকার বাসিন্দা, আইনজীবী সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ছেলেকে স্কুলে পাঠানোই হোক অথবা কাজের জন্য আদালতে যাওয়া, শহরে যানজট লেগেই আছে। যানজটের জেরে রোজদিন এখানকার মানুষ দুর্ভোগে পড়ছেন। অবিলম্বে প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিক।”
পরিস্থিতি দেখে বোলপুরের সাংসদ তথা লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় উদ্যোগে স্টেশন মোড় থেকে শ্রীনিকেতন রাস্তার উপর জামবুনি বাসস্ট্যান্ডের কাছ পর্যন্ত রবীন্দ্রবীথি বাইপাস তৈরি হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও চালু হওয়া ওই বাইপাস এখন শহরের অন্যতম একটি প্রধান রাস্তা। তাতে কিছুটা চাপ কমলেও, ঠিক হয়েছিল এরপরে স্টেশন থেকে শান্তিনিকেতন পর্যন্তও একটি বাইপাস হবে। বেশ কয়েকটি বৈঠকের পরেও সে রাস্তা আর হয়নি! এ দিকে, শহরে যানজটের আর এক মূলে থাকা লালপুল সম্প্রসারণের জন্য কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিক বার নানা পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু হাল পাল্টায়নি। অধীর চৌধুরী কেন্দ্রীয় রেল প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পরও ফের মাপজোক করে গিয়েছেন আধিকারিকেরা। কিন্তু সম্প্রসারণ আজও বিশ বাঁও জলে! ২০১২ সালে পুরপ্রধানের উদ্যোগে পুরসভার সভাকক্ষে যানজট প্রতিকারে বৈঠক হয়। ফলাফল শূন্য! সাম্প্রতিক কালে মহকুমাশাসক মলয় হালদারের উদ্যোগে গত ১০ জানুয়ারি শহরের যানজট প্রতিকার নিয়ে শেষ বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সে বৈঠকেও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্তা-ব্যক্তিরা।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরিচিত বোলপুর-শান্তিনিকেতনের যানজট যন্ত্রণা, এখনও সেই তিমিরেই!