দুই চিত্র। (বাঁ দিকে) সাহায্যের হাত জওয়ানদের। (ডান দিকে) কোপাইয়ের কালুরায়পুরে গণ্ডগোল ও মারধরের সময় জওয়ানদের দেখা যায়নি বলে অভিযোগ। প্রতিবাদে অবরোধ সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের। বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
সিপিএম ৩৪ বছর ধরে যে ভাবে ভোট করেছে, ঠিক সে ভাবেই ভোট করানোর পরামর্শ দলীয় কর্মীদের বারবার দিয়েছেন জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। অন্য দিকে, বীরভূমের দুই লোকসভা কেন্দ্রে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট করানোটাকে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসাবে নিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক সুধীরকুমার রাকেশ।
আপাতদৃষ্টিতে এ দিন শান্তিপূর্ণ ভোটই হয়েছে বোলপুরে। বুথে বুথে লম্বা লাইন। দিনের শেষে ভোট পড়েছে প্রায় ৮৫ শতাংশ। কিন্তু, সেই আপাত শান্তির তলায় লুকোনো ছিল অন্য বাস্তব। বিরোধীদের অভিযোগ, নিজের কায়দায় বোলপুর কেন্দ্রে ভোট করিয়েছেন অনুব্রত মণ্ডল। নানুর থেকে লাভপুর, কেতুগ্রাম থেকে মঙ্গলকোটসর্বত্রই শাসক দলের বিরুদ্ধে নীরব সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছে। বিরোধী দলের পোলিং এজেন্ট বা কর্মী-সমর্থক এমনকী বিরোধী সমর্থক হিসাবে চিহ্নিত ভোটারদের বিভিন্ন এলাকায় বুথের কাছেই ঘেঁসতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। বিরোধী দলগুলির আরও অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন মুখে বেনজির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে তা হয়নি। বরং শাসক দল এক তরফা ভোট করিয়েছে।
বস্তুত, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বসিয়ে রেখে রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে বুথে বুথে সন্ত্রাস এবং রিগিং-এর অভিযোগ তুলে বোলপুরের অন্তত ৩০০ বুথে পুনর্নির্বাচনের দাবি তুলেছেন বোলপুর কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী তথা বিদায়ী সাংসদ রামচন্দ্র ডোম। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “জীবনে এমন নির্বাচন দেখিনি! ৩০০ বুথ দখল, এক তরফা ছাপ্পা, এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি, মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ ভোটারদের পর্যন্ত মারধর করা হয়েছে।”
মারধরের অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়। বোলপুর কেন্দ্রের অন্তর্গত সাঁইথিয়া থানার কালুরায়পুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭৫ নম্বর বুথে থাকা সিপিএমের পোলিং এজেন্ট এবং স্থানীয় এক সিপিএম সমর্থক মহিলা ভোটারকে বেধড়ক মারধর করার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। প্রহৃত পোলিং এজেন্ট বাসুদেব বাগদি বলেন, “সকাল থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান ছাড়া ভোটগ্রহণ চলছিল। ছিল রাজ্য পুলিশের সশস্ত্র রক্ষী। প্রিসাইডিং অফিসার উমেশচন্দ্র মণ্ডলকে বললেও তিনি আমল দেননি। আচমকা বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ পশ্চিমপাড়ার ভোটার ললিতা বাগদি ভোট দিতে এলে তাঁকে বাধা দেন তৃণমূলের পোলিং এজেন্ট পার্বতী চক্রবর্তী। আমি প্রতিবাদ করায় বুথ লাগোয়া তৃণমূলের পার্টি অফিস থেকে রে রে করে লোকজন তেড়ে এসে আমাকে আর ললিতাদেবীকে বুথ থেকে বার করে দেয়।” বাসুদেববাবুর অভিযোগ, বুথের বাইরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের দু’জনকেই বেধড়ক পেটানো হয়। তিনি কোনও মতে পালিয়ে বাঁচলেও পঞ্চাশোর্ধ্ব ললিতাদেবীকে লাঠিপেটাও করা হয়। ঘটনার সময়ে কোথাও আধা সেনাকে দেখা যায়নি।
স্থানীয় বাসিন্দারাই ওই মহিলাকে উদ্ধার করে বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করান। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ললিতাদেবী এখন বিপন্মুক্ত নন। মাথায় কয়েকটি সেলাই পড়েছে। তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। আহত মহিলার ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী নন্দিতা বলেন, “আমরা বরাবর সিপিএম করি। মাকে তৃণমূল ভোট দিতে দেয়নি। প্রতিবাদ করায় এমন নির্দয় ভাবে মেরেছে।” পশ্চিমপাড়ার মোট ভোটার ১৮০ জন। তাঁদের মধ্যে এই ঘটনার আগে পর্যন্ত মাত্র ৩০ জন ভোট দিয়েছিলেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে বাকিরা ভোট বয়কটের সিদ্ধান্ত নেন। আমোদপুর-বোলপুর রাস্তা অবরোধও করা হয়। পরে কেন্দ্রীয় বাহিনির জওয়ানদের গাড়ি আটকে তাঁরা সমস্ত জানান।
এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গিয়েছে, বুথে রয়েছেন রাজ্য সশস্ত্র পুলিশে দুই জওয়ান। বুথ লাগোয়া তৃণমূলের কার্যালয়ে জনা দশেকে যুবকের জটলা। পশ্চিম পাডায় যাওয়ার রাস্তায় ইতিউতি পড়ে রয়েছে ইটের টুকরো। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও বুথের প্রিসাইডিং অফিসার উমেশচন্দ্র মণ্ডল বলে দিলেন, “বুথে মধ্যে তো কিছু ঘটেনি!” ওই বুথের মোট ভোটার সংখ্যা ৯০৯। সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের অভিযোগ, স্থানীয় কোনাইপুরের তৃণমূলের দাপুটে নেতা পীযূষ ঘোষ, রনজিৎ ঘোষ, কনক ঘোষ এবং তৃণমূলের পোলিং এজেন্ট পার্বতী চক্রবর্তী এই হামলার সঙ্গে যুক্ত। তৃণমূল অবশ্য হামলার অভিযোগ করেছে।
বস্তুত, গোটা বোলপুর কেন্দ্রেই ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। কংগ্রেস প্রার্থী তপনকুমার সাহার অভিযোগ, “দুশোটিরও বেশি বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দিয়েছে তৃণমূল। মানুষ নিজের ভোট দিতে পারেনি। এ বার লোকসভা যা দেখলাম, বিশ্বাস করতে পারছি না। মানুষ আতঙ্কিত। সব থেকে বড় বিষয় হল পুলিশ, অবজারভার সবাইকে ব্যক্তিগত ভাবে বারবার ফোন করে অভিযোগ জানিয়েছি। কেউ আমল দেয়নি।” নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোমও। তাঁর মন্তব্য, “কমিশন নিয়ে আর কী বলব? বজ্র আঁটুনির ফস্কা গেরো। কমিশন যা যা শুনিয়েছিল, বাস্তবে তার কিছুই করতে পারেনি। পর্যবেক্ষকেরাও কাজ করেননি। কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের বসিয়ে রাখা হয়েছে। আমরা ৩০০ বুথে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছি।” নানুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত, সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আনন্দ ভট্টাচার্য বলেন, “তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা এলাকার অধিকাংশ বুথে দখল করে নেয়। নিবার্চন কমিশনকে আমরা জানিয়েছি। কিন্তু, তাদের দেখা মেলেনি।” বোলপুরের বিজেপি প্রার্থী কামিনীমোহন সরকারের অভিযোগ, “পরিকল্পনা করে সন্ত্রাস আর রিগিং করা হয়েছে। বুথগুলোতে কেন্দ্রীয় বাহিনী না থাকায় সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি।”
সব শুনে হাসছেন অনুব্রত মণ্ডল। এবং বলছেন, “পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়!”