বোলপুরের ডাকবাংলো মাঠে তৃণমূল প্রার্থী অনুপম হাজরার সঙ্গে মিঠুন। ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিত্ রায়চৌধুরী।
আমি এমএলএ ফাটাকেষ্ট। আমি খবর দেখি না। খবর শুনি না। খবর তৈরি করি। মঞ্চ থেকে ওই সংলাপগুলো উড়ে আসতেই দর্শকদের হাততালিতে মাঠ ভরে গেল। অনেকে গলা চড়িয়ে বলে উঠলেন, “জিও গুরু জিও।”
টিভি বা সিনেমার পর্দায় দেখা নায়ককে সামনাসামনি পেয়ে আরও সংলাপ শোনার জন্য আবদার করলেন দর্শকরা। মিঠুন চক্রবর্তী স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় হাত নেড়ে বললেন, “চারপাশে নির্বাচন কমিশনের ক্যামেরা রয়েছে। তাই এখন এর বেশি কিছু বলব না। শুধু বলি ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত।”
তৃণমূলের প্রচারে এসে বুধবার এ ভাবেই ময়ূরেশ্বরের বাসুদেবপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্র লাগোয়া মাঠ এবং বোলপুরের ডাকবাংলো মাঠে আসা তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের মন ছুঁয়ে গেলেন মিঠুন। বার বার বিতর্কিত মন্তব্য করা তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল কিংবা দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় থাকলেও এ দিন সবার নজর ছিল রাজ্যসভার সাংসদ মিঠুনের উপরেই। বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী অনুপম হাজরার সমর্থনে এ দিন ওই দু’টি সভার আয়োজন করা হয়েছিল। পুলিশ সূত্রে খবর, বাসুদেবপুরে হাজার পাঁচেক এবং বোলপুরে হাজার তিনেক লোকের জমায়েত হয়েছিল।
এ দিন বেলা ১টায় সভা শুরুর কথা ছিল বাসুদেবপুরে। তার আগেই ট্রাক্টর, ভটভটিতে এবং পায়ে হেঁটে মানুষজন পৌঁছে দিয়েছিলেন সভাস্থলে। চারপাশে তখন গনগনে রোদের আঁচ। নিমিষে শেষ হয়ে যাচ্ছে বোতলের জলও। কিন্তু সব উপেক্ষা করেই লোকজন মাঠ ছাপিয়ে মাঠ লাগোয়া বাড়ির ছাদ, গাছের ডালে চড়ে বসেছিলেন। বেলা আড়াইটে নাগাদ কপ্টারের শব্দ কানে আসতেই আকাশের দিক মুখ তোলেন কৌতূহলি জনতা। ধুলোর ঝড় উড়িয়ে মাঠে নামে সবুজ-সাদা রঙের কপ্টার। কপ্টারের রঙের সঙ্গে যেন সাযুজ্য রেখে গলায় সবুজ উত্তরীয়, সাদা পাঞ্জাবি, স্কিন টাইট জিন্স এবং জুতো পরে সবুজ কার্পেটে পা রাখেন সুপারস্টার। পিছনে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। মিঠুনকে আরও কাছে দেখার জন্য ঢেউ খেলে যায় ঝলেসে যাওয়া মুখগুলোয়।
‘গৌরাঙ্গ’ দর্শন। ময়ূরেশ্বরের বাসুদেবপুরে মিঠুন চক্রবর্তীর জনসভায়। ছবিটি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।
মঞ্চে ছিলেন মত্স্য মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ, লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল ইসলাম, বিধায়ক শিউলি সাহা প্রমুখ। মুকুলবাবু তাঁর বক্তব্যে যথারীতি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনা ও চক্রান্তের অভিযোগ তোলেন। কিন্তু দর্শকের চোখ তখন মজে রয়েছে মিঠুনে। মিঠুন মাইক্রোফোন হাতে নিতেই উল্লাসে ফেটে পড়ে মাঠ। মিঠুন বলেন, “পাঁচটা বছরের জন্য তৃণমূল প্রার্থীকে জেতান। যদি সেই প্রার্থী কোনও কাজ না করে, তাহলে পাঁচ বছর পর আপনাদের দেখে নেওয়ার সুযোগ আসবে। তখন আমি আর ভোট চাইতে আসবো না।” দর্শকদের মর্জি বুঝে বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকেই তিনি কখনও বাংলায়, কখনও বা হিন্দিতে তাঁর বিখ্যাত সংলাপ বলেন। ফের হাততালি।
বোলপুর ডাকবাংলো মাঠের সভায় মিঠুন-মুকুলের সঙ্গে ছিলেন অনুব্রত মণ্ডল, জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায় চৌধুরী, দলীয় প্রার্থী অনুপম হাজরা। ছিলেন দুই দলীয় বিধায়ক শেখ শাহনওয়াজ, গদাধর হাজরা-সহ প্রার্থীর বাবা, মা। এঅনুব্রত বলেন, “সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি-কে ভোট দেবেন না। যে ভাবে সিপিএম ৩৪ বছর ভোট করেছে। ঈশারা ইজ কাফি। সেই ভাবে ভোট তা করে দেবেন।” দিন অনুব্রতবাবুর বক্তব্য কিছুটা সংযত হলেও, তাতে উস্কানিমুলক প্ররোচনা ছিল বলে বিরোধীদের দাবি। মিঠুনকে নিয়ে কপ্টার উড়ে গেলেও দুই জায়গাতেই জনতার মধ্যে সম্মোহনের ঘোর ছিল আরও কিছুক্ষণ। মাথা পিছু ১০ টাকা করে ভটভটির ভাড়া দিয়ে পাঁচ কিলোমিটার উজিয়ে লোকপাড়া থেকে বাসুদেবপুরের সভাস্থলে এসেছিলেন দুই গৃহবধূ টুম্পা এবং আলপনা বন্দ্যোপাধায়। তিন কিলোমিটার পায়ে হেঁটে দাদপুর থেকে সভায় আসেন কলেজ পড়ুয়া সুনীল মণ্ডল, সুদেষ্ণা প্রামানিকরা। তাঁরা বলেন, “ভাবতেই পাচ্ছি না, এত কাছ থেকে মিঠুনকে দেখতে পাব। আমরা নেতাদের খটমট রাজনৈতিক বক্তব্য শুনতে আসিনি। কিন্তু মিঠুনের কথা আমাদের মনে গেঁথে গিয়েছে।” একই অভিব্যক্তি বোলপুরের কাছারিপটি গ্যারাজের কর্মী সুরেশ দাস, প্রান্তিকের ক্ষুদ্র চাষি অমল মণ্ডলেরও। তাঁরা বলেন, “সিনেমায় গুন্ডা ফাটাকেষ্ট থেকে মিনিস্টার ফাটাকেষ্ট-র ভূমিকায় মিঠুনকে আমরা দুষ্টের দমন করতে দেখেছি। তাই ওঁকে ভরসা করছি।”