বোলপুর আদালতে অপহরণকারীদের নিয়ে পুলিশ। —নিজস্ব চিত্র
ভূতের বরে চাইলেই নাকি, মিলে যায়! তবে এ ভূত গুপিবাঘার দেখা ভূত নয়। অপহরণকারীদের ফাঁদা গল্পে দেড় ফুটের বামন ভূত!
এমনটা শুনেই বীরভূমের নানুর থানার কড্ডা গ্রামে ভূত দেখতে গিয়েছিলেন হুগলির চণ্ডীতলা থানার, মিত্র ভট্টাচার্য পাড়ার বাসিন্দা নিতাই চন্দ্র আদক-সহ আরও চার ব্যক্তি। আর ভূত দেখতে গিয়েই, অপহরণকারীদের খপ্পরে পড়েন পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রী নিতাইবাবু ও সঙ্গীরা। বেগতিক বুঝে সঙ্গীদের মধ্যে দু’জন পালালেও মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণকারীরা তাঁদের প্রাণে মারার হুমকি দেয়। শেষ অব্দি বন্ধুদের সহযোগিতায়, বৃহস্পতিবার ভোর রাতে পুলিশ উদ্ধার করল তাঁদের।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দিন পনেরো আগে চণ্ডীতলায় স্থানীয় রাজমিস্ত্রী আবদুল খালেক নামে এক ব্যাক্তির সঙ্গে আলাপ হয় নিতাইবাবুর। আব্দুলের দেওয়া নাম-ঠিকানা অনুযায়ী, তিনি নানুরের কড্ডা গ্রামে যান ভূত দেখতে। এ দিন বোলপুর থানায় বসে তিনি বলেন, “কড্ডা গ্রামের বাসিন্দা বিপদতারণ দাসের কাছে গিয়ে সে বার ভূত দেখা হয়নি। উনি বলেছিলেন, ‘এখন সময় চলে গিয়েছে।” ভূত না দেখতে পাওয়ার বিষয়টিও আবদুলকে জানিয়েছিলেন তিনি। এরইমধ্যে ফের সুযোগ এসে যায়।
নিতাইবাবুর দাবি, বিপদতারণ দাস তাঁকে ফোন করেন ফের গ্রামে যাওয়ার জন্য। এ বার আর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি তিনি। ইতিমধ্যেই চেনা পরিচিতদের কাউকে কাউকে তিনি দেড় ফুটের ভূতের গল্প বলেছিলেন। তারমধ্যে রয়েছেন এলাকার জগদিশপুরের বাসিন্দা সুভাষ দাস। সুভাষবাবুই বালির সাপুই পাড়ার বাসিন্দা সৌরভ চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন নিতাইবাবুর।
গত সোমবার, সৌরভ তাঁর আরও দুই বন্ধু, কৃষ্ণরামপুরের সমীর দাস ও রিষড়ার বাসিন্দা স্বজল ঘোষকে নিয়ে নিতাইবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন ভূতের সন্ধানে। পেশায় ওষুধের ব্যবসায়ী সৌরভবাবু বলেন, “বর্ধমানে ট্রেন থেকে নেমে বিপদতারণের পাঠানো গাড়িতেই আমরা কড্ডা যাই। বিপদতারণের সঙ্গে কথা বলার পর আমার দুই বন্ধু আর থাকতে চায়নি। ওরা মঙ্গলবার বাড়ি ফিরে যায়। এর মধ্যে নিতাইবাবুর আর আমার মোবাইল নিয়ে সিম কার্ড কেড়ে নেওয়া হয়। মারধর করা হয়। প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে, এটিএম থেকে ৩২০০০ টাকা তুলে নেওয়া হয়।” কেড়ে নেওয়া হয়, নিতাইবাবুর কাছে থাকা হাজার পাঁচেক টাকাও।
পুলিশ সূত্রে খবর, এরপরই কড্ডা এলাকার মাঠের মধ্যে একটি বাড়িতে নিতাইবাবু ও সৌরভবাবুকে আটকে রেখে অপহরণের খবর দেওয়ার ছক কষে অপহরণকারীরা। পনেরো-ষোল জনের একটি দল নানা ভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে থাকে তাঁদের উপর। বাড়িতে খবর দেওয়ার কথা বললে, সে সময় সৌরভবাবু তাঁর বন্ধু অজয় সিংহকে মুক্তিপণের কথা জানাতে বলেন। সেই মতো অজয়বাবুকে ফোন করে তেরো লক্ষ টাকা মুক্তিপণ চায় অপহরণকারীরা। যা পরে রফা হয় চার লক্ষ টাকায়। ঠিক হয়, সৌরভবাবুর ছয় বন্ধু বুধবার টাকা নিয়ে এসে তাঁদের নিয়ে যাবেন। বোলপুরের ত্রিশুলাপটিতে তাঁদের দেখে, তবেই অপহরণকারীদের টাকা দেবেন তাঁরা।
বিপদ বুঝে সৌরভবাবুর বন্ধুরা বুধবারই বোলপুরে চলে আসেন। গভীর রাতে বোলপুর থানায় অভিযোগ জানিয়ে তাঁরা পুলিশি সহায়তা চান। পুলিশ সূত্রে খবর, এসডিপিও অম্লান কুসুম ঘোষের নির্দেশে, সিআই চন্দ্র শেখর দাস এবং আইসি দেব কুমার রায়ের তত্ত্বাবধানে পুলিশ বাহিনী নিয়ে ফাঁদ পাতেন ত্রিশুলাপট্টি এলাকায়। এলাকাজুড়ে সাদা পোশাকে পুলিশ অপেক্ষা করতে থাকে। সৌরভবাবু ও নিতাইবাবুকে নিয়ে এলাকায় অপহরণকারীরা এসে পৌঁছতেই পুলিশ তাদের ঘিরে ধরে।
বোলপুরের এসডিপিও বলেন, “অপহরণ এবং মুক্তিপণ চাওয়ার অভিযোগ পেয়ে, পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপহৃত দুই ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়েছে। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এই চক্রের সঙ্গে আর কারা যুক্ত আছে, তদন্ত করে দেখছি।”
যে গাড়িটি বর্ধমান স্টেশন থেকে নিতাইবাবুদের কড্ডা গ্রামে নিয়ে গিয়েছিল, সেই গাড়িটি নিয়েই গোয়ালডিহির বাসিন্দা শেখ জমিরুল এসেছিলেন এ দিন ভোরে মুক্তিপণ নিতে। পুলিশ তাঁকেও গ্রেফতার করেছে। এ ছাড়া নানুর থানার ব্রাহ্মণডিহির বাসিন্দা স্বপন দাস, কড্ডা গ্রামের বিপদতারণ দাস ও মুলুকের আয়নাডাঙ্গার অনিল বাগদী, লাভপুরের তাপস দাসকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ধৃতদের এ দিন বোলপুর আদালতে তোলা হয়। সরকারি আইনজীবী ফিরোজ কুমার পাল বলেন, “তদন্তকারী অফিসার প্রসেনজিৎ দত্ত দুই অপহৃত ব্যক্তির ১৬৪ গোপন জবানবন্দী নেওয়ার আর্জি জানিয়েছিলেন। ভারপ্রাপ্ত এসিজেএম সৌরভ নন্দী সে আর্জি মঞ্জুর করেছেন। ঘটনায় ধৃত দুই ব্যক্তিকে পাঁচ দিন পুলিশ হেফাজত ও বাকি তিন জনকে ১৪ দিন জেল হাজতের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।”