খড়মাডাঙা গ্রামে চলছে যজ্ঞ। বুধবার সকালে ছবিটি তুলেছেন অনির্বাণ সেন।
গুঞ্জনটা শোনা যাচ্ছিল মঙ্গলবার থেকেই।
বুধবার রামপুরহাট শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে বনহাট পঞ্চায়েতের খড়মাডাঙা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, গুঞ্জনটা সত্যিই। ধর্মান্তরণের যাবতীয় আয়োজন প্রায় পাকা। ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলার শিকারিপাড়া, পখুড়িয়া, রদিপুর এই সব এলাকা থেকে শতাধিক আদিবাসী খ্রিস্টান ও মুসলিম মানুষজনকে নিয়ে এসেছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি)। তাঁদেরই অনেককে এ দিন ফর্মে সই করিয়ে এবং পুজো-যজ্ঞের মাধ্যমে ফের হিন্দুধর্মে ফেরানো হল।
এক অর্থে ‘ঘর ওয়াপসি’।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নামে স্থানীয় রদিপুর গ্রামের এক ব্যক্তি ৫ বিঘে জমি দান করেছিলেন ৩৮ বছর আগে। তাঁর ইচ্ছা ছিল ভিএইচপি-র স্কুল বা হাসপাতাল হবে। বুধবার ওই জমিতে আদিবাসী ছাত্রাবাস, মন্দির আর গোপালন কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন ভিএইচপি-র কেন্দ্রীয় ধর্ম প্রচারক যুগল কিশোর। ছিলেন সংগঠনের ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের কর্মকর্তা অচ্যুতানন্দ কর-সহ আরও কার্যকর্তা। ওই কর্মসূচির ফাঁকেই এ দিন ধর্মান্তরণ করানো হয় ওই আদিবাসী ও মুসলিম পরিবারগুলিকে। মহিলাদের পরনে ছিল লালা পাড় সাদা শাড়ি। পুরুষদের সাদা ধুতি আর জামা। ধর্মান্তরণের জন্য এঁদের প্রত্যেককে একটি ফর্মে সই বা টিপসই দিতে হয়েছে। ফর্মের মাথায় লেখা ছিল ‘শপথ পাঠ’। আর লেখা রয়েছে, কোনও রকম প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে বা চাপে পড়ে নয়, তাঁরা প্রত্যেকে হিন্দু ধর্মে যাচ্ছেন স্বেচ্ছায়। এমনকী, লেখা রয়েছে, ধর্মান্তরণের জন্য তাঁর আগাম ভিএইচপি-র কাছে আবেদনও করেছিলেন। এই গোটা কাজের তদারকি করছিলেন অচ্যুতানন্দ এবং ভিএইচপি-র দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম কার্যকর্তা বাদল দাস। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভিএইচপি-র একাধিক কর্তা জানিয়ে দিলেন, এখানে মূল অনুষ্ঠান ধর্মান্তরণেরই! তার পাশাপাশি রয়েছে ওই ছাত্রাবাস ও গোশালার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন।
ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে পুজোপাঠ, যজ্ঞ ও নাম সংকীর্তন। ধীরে ধীরে যজ্ঞস্থলে খ্রিস্টান ও মুসলিম পরিবারের সদস্যদের বসিয়ে শুরু হয়ে যায় আনুষ্ঠানিক ধর্মান্তরণ ও শুদ্ধিকরণ। যুগল কিশোরের বক্তব্য, “ধর্মান্তরণকে আমি সমর্থন করি। কারণ, এটা নিজের ধর্মে ফিরে আসা।”
কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লিতে নিজের বক্তৃতায় বলেছেন, প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব ধর্মাচরণ করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। তা হলে অন্য ধর্মের লোকেদের কেন হিন্দু ধর্মে নিয়ে আসা হচ্ছে? যুগল কিশোরের কথায়, “উনি তো ঠিকই বলেছেন। আমরাও চাই, জোর করে ধর্মান্তরণ না হোক।” তা হলে রামপুরহাটে কী হল? তাঁ দাবি, “ওই পরিবারগুলিকে এক সময় জোর করে ধর্মান্তরণ করানো হয়েছিল। কিন্তু, আমরা তো জোর খাটাচ্ছি না! কাউকে জোর করে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করা হচ্ছে না। যাঁরা জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন, তাঁরাই আবার স্বধর্মে ফিরে আসছেন। এ ক্ষেত্রে কোনও অন্যায় নেই।”
ভিএইচপি সূত্রের খবর, এ দিন ধর্মান্তরিত হয়েছে অন্তত ৫০টি আদিবাসী খ্রিস্টান ও মুসলিম পরিবার। যাঁরা ধর্মান্তরিত হলেন, তাঁদের অধিকাংশই শিকারিপাড়ার বাসিন্দা।তাঁদেরই কয়েক জন জানালেন, তাঁরা শিকারিপাড়ার পাথর শিল্পাঞ্চলে কাজ করেন। কেউ কেউ নাম সইটুকু করতে পারেন। বাকিরা সেটাও পারেন না। পানু মুর্মু, শ্রীমতি বাস্কেরা বললেন, “মাস তিনেক হল আমরা খ্রিস্টান হয়েছিলাম। কিন্তু, বেশ কিছু সমস্যা হচ্ছিল। তাই স্বেচ্ছাতেই হিন্দু ধর্মে ফিরলাম।” আর্থিক প্রলোভন বা জোর খাটানোর কথা তাঁরা অস্বীকার করেছেন। এ দিনের অনুষ্ঠান উপলক্ষে হাজারেরও বেশি লোককে খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করেছিল ভিএইচপি।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের নভেম্বরেও বনহাট পঞ্চায়েত এলাকারই ভাটিনা গ্রামে ধর্মান্তরণ কর্মসূচি নিয়েছিল ভিএইচপি। তবে, তখন স্থানীয় আদিবাসীদের হিন্দু ধর্মে ফেরানো হয়েছিল। এ দিনই রামপুরহাট শহরে ভিএইচপি-র সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সম্মেলন ছিল। সেখানে এসেছিলেন সংগঠনের শীর্ষ নেতা প্রবীণ তোগাড়িয়া। খড়মাডাঙা গ্রামে যাঁরা ধর্মান্তরিত হয়েছেন, তাঁদের অনেককেই তোগাড়িয়ার সভায় নিয়ে আসা হয়েছিল গাড়িতে চাপিয়ে। ধর্মান্তরণের প্রসঙ্গে এ দিন ঘুরেফিরে এসেছে তোগাড়িয়ার বক্তৃতাতেও। তিনি বলেন, “ধর্মান্তরণের শিকার সবচেয়ে বেশি হিন্দুরাই। ধর্মান্তরণ না হলে পাকিস্তান, বাংলাদেশই তো তৈরি হত না!” এর পরেই তিনি তোলেন অনুপ্রবেশ সমস্যা। তোগাড়িয়ার বক্তব্য, “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে।”
রামপুরহাটের তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “সুস্থ সামাজিক পরিবেশকে বিষিয়ে দিতে চাইছে বিজেপি এবং ভিএইচপি-র মতো গেরুয়াধারীরা। মানুষ এদের পছন্দ করেন না। তাঁরা ঠিকই এ সবের জবাব দেবেন। ধর্মান্তরণের কথা আমিও শুনেছি। মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য নেতৃত্ব সব জানাব।” তাঁর আরও দাবি, “এর আগেও রামপুরহাটে ধর্মান্তরণ করিয়েছে ভিএইচপি। এটা তাদের চালু কর্মসূচি। কিন্তু তার কোনও লাভ হয় না। কারণ, মানুষ ওদের বিশ্বাস করে না।”