টিলা কেটে গড়ে উঠছে ঘরবাড়ি। ছবি: অনির্বাণ সেন।
এখানে টিলার মাথার উপরের গ্রামগুলি দিগন্তরেখা বরাবর মিশে আছে। আত্মজীবনীতে নলহাটি পাহাড়ের এমন বর্ণনাই লিখে গিয়েছেন সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সাহিত্যিকের দেখা সেই টিলা সম্পর্কে আজ আর সে কথা বলা যাবে না। গোটা টিলাটাই একটা যত্রতত্র নির্মাণে বিপর্যস্ত। একসময় নলহাটি পাহাড় নলহাটি ১ পঞ্চায়েত এলাকায় ছিল। ’৯২ সালে নলহাটি ১ পঞ্চায়েতের সদস্য বর্তমানের নলহাটি পুরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা কাজি ইমদাদুল হক, নলহাটি পাহাড়ে মন্দির, মাজার এবং ইদগাহ মিলে ১০০ বিঘের বেশি জায়গা ছিল। নলহাটি পাহাড়ে আগে কেবলমাত্র আজকের নলহাটি ১ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল। আর স্বাস্থ্য কেন্দ্র ঘিরে চিকিত্সক নার্স, হাসপাতাল কর্মীদের থাকার জায়গা ছিল। এখন নলহাটি মন্দির, মাজার, ইদগাহর জায়গা বিভিন্ন লোকে বিভিন্ন ভাবে দখল করে নিয়েছে। এর ফলে পাহাড়ের সেই ঐতিহ্য এবং সৌন্দর্য হারিয়ে গিয়েছে।
পাহাড়ে উঠলেই দেখা যায়, নলহাটি ১ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতালের আবাসন যেমন আছে, তেমনি গড়ে উঠেছে শ্রী রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম, সরকারি কমিউনিটি হল, সরকারি অনুষ্ঠান ভবন, ইদগাহ সংস্কার হয়েছে। সৌন্দর্যায়ন হয়েছে মাজার, মন্দিরের। আর তাদের ঘিরেই হয়েছে নতুন নতুন বসতি। পাহাড় কেটে লাল মোরাম রাতের অন্ধকারে চুরি করার একটি চক্র এখনও এলাকায় সক্রিয়। পাহাড়ের জায়গা বাঁচাতে এলাকার মানুষ একসময় আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তার আগে অবশ্য বেদখল হয়ে গিয়েছে অনেক জায়গা। এলাকার বাসিন্দা তথা নলহাটি হীরালাল ভকত কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ জগন্নাথ রায়চৌধুরী বলেন, “১৭৪২-৪৩ সালে মারাঠারা ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে তখনকার বঙ্গ বিহার ওড়িশার নবাব আলিবর্দির খাঁর বিরুদ্ধে বঙ্গদেশ আক্রমণ করেছিল। বর্গী হাঙ্গামা বলে যা ইতিহাসে খ্যাত। বর্গীরা সম্ভবত নলহাটির পূর্ব দিকে আজিমগঞ্জের গঙ্গা দিয়ে এসেছিল। এবং মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করেছিল। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে এই ইতিহাস পাওয়া যায়।” তিনি আরও বলেন, “লোকশ্রুতি এই যে, নলহাটির টিলার উপর অবস্থিত বর্গীডাঙা নামে পরিচিত অংশেই মারাঠারা তাদের শিবির বেঁধেছিল। নলহাটির এই টিলাতে বর্গীদের সঙ্গে ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়েছিল এবং এই টিলাতেই দু’টি মুসলিম সৈন্যের সমাধি আছে বলে লোকের বিশ্বাস। স্থান দু’টিও চিহ্নিত আছে।”
এলাকাবাসীর অভিযোগ, একটা ঐতিহাসিক গুরুত্বকে পদদলিত করে নানা চালাকির মধ্য দিয়ে কেবল মাত্র ‘বর্গীডাঙা’র জায়গা রেখে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে অন্য জায়গা। নলহাটির এই পাহাড় বাঁচাতে এলাকাবাসী সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে লিখিত ভাবে আবেদন করেছিলেন। নলহাটি ১ ব্লকের বিডিও তাপস বিশ্বাসের দাবি, “নলহাটি পাহাড়ের যে সরকারি খাস জায়গা সেই জায়গা এখনও কেউ দখল করেনি। ওই জায়গায় সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন গড়ে উঠেছে তেমন পাহাড় সংলগ্ন ব্লক অফিসের চারপাশ প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। বাগান হয়েছে। তবে পাহাড়ের জায়গায় আর ২০১২-১৩ সালের পর থেকে নতুন করে ব্যক্তিগত ভাবে কাউকে বাড়ি করতে দেওয়া হচ্ছে না।”
নলহাটি ১ ব্লক ভূমি এবং ভূমি সংস্কার আধিকারিক কৃষ্ণেন্দু বিশ্বাস বলেন, “পাহাড়ের উপর ১০২২ দাগে প্রায় ৩৫ বিঘে জমি এখনও সরকারি খাস জায়গা বলে চিহ্নিত আছে। এখন সেই জায়গায় কেউ যদি জবর দখল করতে আসে তা হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি পাহাড় কেটে কেউ যদি রাতের অন্ধকারে মোরাম চুরি করছে সেটা দেখতে পেলে বা কোনও রকম কেউ যদি অভিযোগ করেন এবং অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়, অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর পাহাড়ের জায়গায় কোনও রকম নির্মাণ হচ্ছে কি না সেটা দেখভাল করবে পুরসভা। কারণ, সমস্ত নির্মাণ কাজের অনুমতি দেয় পুরসভা।”
নলহাটির প্রাক্তন পুরপ্রধান বিপ্লব ওঝা অবশ্য বলেন, “পাহাড়ের সম্পত্তি নসিপুরের রাজাদের দখলে ছিল। সরকার তাদের কিছু জায়গা খাস করেছিল। সেই খাস জায়গা কেউ কেউ দখলও করে। পরে সেই জায়গায় নির্মাণ শুরু করার অনুমতি নিতে চাইলে বিষয়টি পুরসভার নজরে আসে এবং পরবর্তীতে পুরসভা থেকে সরকারি রেকর্ডভুক্ত জায়গার উপর কোনও নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলেই জানি।” বর্তমান পুরপ্রধান রাজু সিংহ বলেন, “নলহাটি পাহাড়ের জায়গা বেদখল আমার আমলে আটকানোর জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা চলছে এটকু বলতে পারি।”
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-বীরভূম’।
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, বীরভূম বিভাগ, জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।