কেতিকা এলাকায় মধুমিতার শ্বশুরবাড়ির সামনে বসেছে পুলিশ পিকেট। —নিজস্ব চিত্র
যে বধূ-মৃত্যুর ঘটনাকে ঘিরে শনিবার উত্তাল হয়েছিল পুরুলিয়া শহরের কেতিকা এলাকা, সেই ঘটনায় মৃতার শ্বশুর ও শাশুড়িকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জেলা পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীরকুমার বলেন, “মৃত বধূ মধুমিতা চৌধুরীর ভাইয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা শুরু করা হয়েছে। শ্বশুর মণীন্দ্রনাথ চৌধুরী ও শাশুড়ি লিলি চৌধুরীকে পুলিশ ধরেছে।” বধূর স্বামী পার্থসারথি চৌধুরী ও ননদ টুম্পা গরাইয়ের নামেও অভিযোগ হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যার ওই ঘটনাকে ঘিরে কেতিকায় এলাকায় ধুন্ধুমার বেধে যায়। এলাকার চৌধুরী বাড়ির তিনতলার চিলেকোঠা থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখে স্থানীয় বাসিন্দাদের সন্দেহ হয়। লোকজন বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখেন, চিলেকোঠার মেঝেয় পড়ে রয়েছে মধুমিতার অগ্নিদগ্ধ দেহ। বাড়িতে শাশুড়ি-বৌমার দূরত্বের কথা জানতেন স্থানীয় কিছু লোকজন। মুহূর্তে চাউর হয়ে যায়, ওই বধূকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। এর পর উত্তেজিত জনতা ওই বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। বাড়ি লাগোয়া চৌধুরী পরিবারের একটি স্কুলেও ভাঙচুর হয়। আগুন লাগানো হয় বাড়ির মূল গেট লাগোয়া গ্যারেজে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে পুলিশ-জনতা খণ্ডযুদ্ধ বাধে। বিশাল বাহিনী নিয়ে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন পুলিশ সুপার এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্য। ঘটনার সময় বাড়িতে ছিলেন মধুমিতা দেবীর শাশুড়ি লিলি চৌধুরী। জনরোষ থেকে বাঁচাতে পুলিশ রাতেই তাঁকে আটক করে। পরে, দমকলের দু’টি ইঞ্জিন ঘণ্টা দুয়েকের চেষ্টায় আগুন আয়ত্তে আনে। রাতে এলাকায় পুলিশি টহল ছিল। ওই বাড়ির সামনেও পুলিশ পিকেট বসেছে। এই ঘটনায় পুলিশ একটি পৃথক মামলা রুজু করেছে।
স্থানীয় সূত্রের খবর, ২০০৫ সালে ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ জেলার চিরকুন্ডার বাসিন্দা মধুমিতার সঙ্গে বিয়ে হয় কেতিকার পার্থসারথি চৌধুরীর। অ্যাকাউন্টেন্সির অনার্স এবং কত্থক নৃত্যে পারদর্শী মধুমিতা বিয়ের পর থেকেই স্বামীর স্কুলকে কী করে আরও ভালভাবে চালানো যায়, সেদিকে মন দেন। এবং তা করতে গিয়ে পারিবারিক কাজকর্মের ক্ষেত্রে শাশুড়ির সঙ্গে সাংসারিক ব্যাপারে সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। রবিবার পুরুলিয়া সদর থানায় বসে মধুমিতার বোন সুস্মিতা সাহা অভিযোগ করেন, তাঁর দিদি ইদানীং খুব কম কথা বলতেন। ওরকম এক জন প্রাণখোলা মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে অশান্তির মধ্যে গুটিয়ে গিয়েছিলেন। মধুমিতার একমাত্র ছেলেকে তাঁর ননদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এটা নিয়েও দিদির মধ্যে হতাশা ছিল। সুস্মিতাদেবীর কথায়, “দিদি জামাইবাবু মানে পার্থদাকে নিয়েও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগত। বলত, ওকে জামাইবাবু ডিভোর্স দেবেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করাতেই মনে হয় দিদিকে এ ভাবে মূল্য দিতে হল!”
মৃত বধূর ভাই সৌরভ গরাই বলেন, “আমরা খবর পেয়েই আজ ছুটে এসেছি। মৃতদেহ দেখেছি। আমাদের ধারণা, দিদিকে খুন করে তার প্রমাণ লোপাটের জন্য গায়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। না হলে কারও গায়ে আগুন লাগলে সে তো চিৎকার করবেই!” মধুমিতার স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি এবং ননদ টুম্পা গরাইয়ের বিরুদ্ধে সৌরভ অভিযোগ দায়ের করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার পারিবারিক একটি কাজ থাকায় মধুমিতা চিরকুন্ডা গিয়েছিলেন। তবে, খুব চুপচাপ ছিলেন। বলছিলেন, শ্বশুরবাড়িতে ভাল লাগছে না। “তখন কি জানি, ওকে এ ভাবে চিরতরে হারাতে হবে! তা হলে দিদিকে আর আসতে দিতাম না।’’আক্ষেপ ঝরে পড়ে সৌরভের গলায়।
তদন্তে পুলিশও জেনেছে, বাপের বাড়িতে কাজ মিটিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাতেই মধুমিতা পুরুলিয়ায় ফিরে আসেন। পরের দিন শ্বশুরবাড়িতে কোনও সমস্যা হওয়ায় পুলিশের কাছে যান। সুস্মিতাদেবীর কথায়, “শুক্রবার দিদিকে ফোন করায় জানতে পারি, থানায় রয়েছে। কিন্তু কেন, তা দিদি বলেনি।” পুলিশ জানিয়েছে, শুক্রবার মধুমিতা পুরুলিয়া সদর থানায় এলেও মহিলা সংক্রান্ত বিষয় বলে তাঁকে মহিলা থানায় পাঠানো হয়। তিনি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে চান কি না জানতে চাওয়া হলে, তিনি না বলেন। তখন পুলিশ দিয়েই ওই বধূকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর ভাই সৌরভ অবশ্য এদিন বলেন, এ বিষয়টি আমি জানি না। এনিয়ে আমাদের ফোনে কিছু বলেও নি।
মৃতার স্বামী পার্থসারথি চৌধুরী দিন কয়েক আগে দিল্লিতে গিয়েছেন। তিনি ফোনে বলেন, “আমি সব শুনেছি। বাড়ি ফিরে আসছি।” তাঁর আরও দাবি, মধুমিতার সঙ্গে তাঁর আইনি বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। সেই কাগজপত্রও তাঁর কাছে রয়েছে। তিনি ফিরে পুলিশের কাছে যাবেন। বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পরেও কেন মধুমিতা ওই বাড়িতেই ছিলেন, সে প্রশ্নের সদুত্তর পার্থসারথি দিতে পারেননি। সন্তানকে অন্যত্র পাঠানো নিয়ে পার্থসারথির বক্তব্য, “আমার স্ত্রী ছেলেকে যত্ন করত না। তাই ওকে দিদির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।”
মধুমিতার সঙ্গে পার্থসারথির আইনি বিচ্ছেদের বিষয়টি অবশ্য মৃতার বাপের বাড়ির লোকজন মানতে চাননি। মধুমিতার জামাইবাবু সন্দীপ সাহা বলেন, “এ কথা ঠিক নয়। আমার শ্যালিকার মৃতদেহ তো ওর শ্বশুরবাড়িতেই পাওয়া গিয়েছে! আমরা মনে করছি, এই ঘটনা পূব পরিকল্পিত। চক্রান্তে কারা যুক্ত, পুলিশের খুঁজে বের করা দরকার।”