গোটা ব্লকে বিরোধী বলে কার্যত কিছু নেই। পঞ্চায়েত ও লোকসভা নির্বাচনে শাসক দলের বিরুদ্ধে এখানে এক তরফা ভোট করানোর অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা।
এ হেন নানুরে ভাঙুচর চলল তৃণমূলেরই পার্টি অফিসে! এবং যে সে অফিস নয়। খোদ ব্লক কার্যালয়েই। বেদম মার খেলেন নানুর পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি-সহ দুই তৃণমূল নেতা। মঙ্গলবার নানুর ব্লক তৃণমূলের কার্যালয়ে এই হামলার ঘটনায় অভিযোগের তির কিন্তু সিপিএম বা বিজেপি-র দিকে নয়। বরং, শাসক দলেরই বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর দিকে। এবং এই ঘটনাকে ঘিরে আরও এক বার নানুরে জেলা তৃণমূলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী এবং দলের বিরোধী গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের ছবিটা সামনে এসেছে।
ঘটনার সূত্রপাত এ দিন সকাল দশটা নাগাদ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এক দল যুবক ম্যাটাডরে চেপে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে চড়াও হয়। সেখানে তখন হাজির ছিলেন নানুর পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি মধুসূদন পাল, দলের নানুর অঞ্চল কমিটির সভাপতি চন্দন পাল প্রমুখ। হামলাকারীরা ওই দুই নেতাকে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটায়। ভাঙচুর করা হয় দলীয় কার্যালয়ও। মধুসূদনবাবুকে ভর্তি করানো হয়েছে বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে। তাঁর দুই পায়ে চোট রয়েছে বলে হাসপাতাল সুত্রে জানানো হয়েছে। মধুসূদনবাবু অবশ্য কে বা কারা ওই কাণ্ড ঘটিয়েছে তা বলতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, “পার্টি অফিসে বসে থাকার সময় আচমকাই এক দল লোক এসে আমাদের ওপর চড়াও হয়। তারা কারা, তা বলতে পারব না।”
এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেল, তৃণমূলের কার্যালয়ের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে গোটা চারেক মোটরবাইক। পড়ে আছে ভাঙা চেয়ার-টেবিলও। তৃণমূল নেতা চন্দনবাবু বলেন, “কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক দল লোক আমাদের মারধর করে ওই ভাবে ভাঙচুর চালিয়ে গেল।” স্থানীয় কিছু বাসিন্দা জানিয়েছেন, ওই যুবকেরা লাঠি নিয়ে ম্যাটাডরে চেপে নানুর বাসস্ট্যান্ডে এসেছিল। এলাকার তৃণমূল বিধায়ক গদাধর হাজরা, বর্তমান ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্যকে ‘না মেরে তারা জল খাবে না’ বলে পার্টি অফিসের দিকে চলে যায়। দলের নানুর ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন, “কাজল শেখের ছেলেরাই এলাকা একক ভাবে কর্তৃত্ব করার জন্য ওই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে খবর পেয়েছি। তবে বাইরে রয়েছি। তাই বিশদে কিছু বলতে পারছি না।”
নানুর লাগোয়া বর্ধমানের কেতুগ্রামের দলীয় বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজের ভাই কাজল শেখ বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরোধী হিসাবেই পরিচিত। তাঁর দুই ভাইকে খুন করার অভিযোগ রয়েছে সিপিএমের বিরুদ্ধে। গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদের একটি আসন ছাড়া, নানুর ব্লকে পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূল ও বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীরা ছাড়া অন্য কোনও দল প্রার্থী দিতে পারেনি। জেলা পরিষদের ওই একমাত্র আসনটিতেই জেলা সভাপতির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সুব্রত ভট্টাচার্য হেরেছেন। তৃণমূলের ক্ষমতাসীন শিবিরের দাবি, সুব্রতবাবুর হারের পিছনে ভূমিকা ছিল কাজলের। দলের নতুন জেলা কমিটিতেও কাজলের ঠাঁই হয়নি।
গত রবিবার নানুর ব্লক কার্যালয়ে দলীয় নেতৃত্ব এবং নানুর ব্লকের ১১টি অঞ্চল কমিটির সভাপতিদের নিয়ে ডাকা বৈঠকে কাজলকে পদে (যুব তৃণমূলের জেলা সভাপতি) ফেরানোর দাবি ওঠে। সেই বৈঠকে ছিলেন ব্লক সভাপতি সুব্রতবাবু ও মধুসূদনবাবু। কিন্তু, সে দিন কাজলের ব্যাপারে নেতাদের কাছ থেকে কোনও নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। এ দিন পার্টি অফিসে হামলা সেই ক্ষোভের জের হতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, নানুরের বিধায়ক গদাধর হাজরাও এক সময়ে কাজল শেখের ঘনিষ্ঠ এবং অনুব্রত-বিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু, সম্প্রতি অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে বলেই তৃণমূল সূত্রের খবর। কাজল শেখের অভিযোগ, “প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, মৎস্য দফতরের (অনুব্রত ঘনিষ্ঠ চন্দ্রনাথ সিংহ রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী) ঘরের কোটা-সহ বিভিন্ন ফায়দার জন্য গদাধর হাজরা অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে ভিড়েছে। টাকার বিনিময়ে তৃণমূল নেতা সোনা চৌধুরী খুনে অন্যতম অভিযুক্তকেও মৎস্য দফতরের ঘর পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকী সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে আসা সুবিধাবাদীরাও দলের পদে জায়গা করে নিয়ে মোটা টাকা কামাচ্ছেন।” কাজলের আরও দাবি, পার্টি অফিসে বসে কিছু নেতা সমস্ত রকম অসামাজিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারই জেরে এ দিন সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নানুর পার্টি অফিসে।
ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া এবং বর্তমানে দলের জেলা সহ-সভাপতির পদে থাকা অভিজিৎ সিংহ বলেন, “‘এ ব্যাপারে আমি কিছু মন্তব্য করব না। যা বলার দলই বলবে।” মৎস্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি চন্দ্রনাথ সিংহও ওই বিষয়ে কিছু না জেনে মন্তব্য করবেন না বলে জানিয়েছেন। বিধায়ক গদাধরবাবুর দাবি, “সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ করছেন কাজল। যারা নিজেরা দুর্নীতি এবং নানা কুকর্মের সঙ্গে জড়িত, তাঁরাই ওই অভিযোগ তুলছেন।”