রক্ষকই ভক্ষক!
গত কয়েক বছর ধরে অন্তত এমনটাই অভিজ্ঞতা দুবরাজপুরের মানুষের। শহরজুড়ে একে একে পুকুর ভরাট করে বড় বড় বাড়ি তৈরি হচ্ছে। বাদ পড়ছে না পুকুরের পাড়ও। প্রকাশে এমন আইন বিরুদ্ধ কাজ হতে দেখলেও প্রশাসনের দিক থেকে পদক্ষেপ দূরঅস্ৎ, কোনও নজরদারিও দেখতে পান না শহরবাসী। অভিযোগ, পুর-প্রশাসনের একাংশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতেই এক শ্রেণির দালাল এই কারবারে যুক্ত। যাদের ভয়ে বাসিন্দাদের অনেকেই মুখ খোলার সাহস পান না। কিন্তু পুকুর ভরাট করে বাড়ি তৈরির এই কারবারের এখন এতটাই রমরমা যে, অদূর ভবিষ্যতে শহরে একটি জলাশয়ও বেঁচে থাকবে কি না বাসিন্দাদের সন্দেহ। ভবিষ্যতের জলাশয়হীন দুবরাজপুর ঠিক কোন বিপদের সামনে দাঁড়াতে চলেছে, তা প্রশাসনের কারও চোখেই পড়ছে না বলে শহরের অধিকাংশ বাসিন্দার অভিযোগ। শহরের এক বাসিন্দার খেদ, “যে শহরে খোদ পুরপ্রধানই পুকুর বুজিয়ে বাড়ি তৈরি করেছেন, তার ভবিষ্যত তো এমনটাই হবে!”
এমনিতেই, ইকো সিস্টেম রক্ষা করতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী দেশের কোনও পকুর পাড়েই গার্ডওয়াল দেওয়া নিষিদ্ধ। সেখানে দুবরাজপুরে পুকুর পাড়ে বড় বড় বাড়ি তৈরি হয়ে যাচ্ছে! এতে পরিবেশের উপর বড় আঘাত হানা হচ্ছে বলেই পরিবেশবিদদের মত। কিছুটা হলেও অভিযোগের যে সত্যতা রয়েছে, তা মেনে নিয়েছে দুবরাজপুরের ক্ষমতাসীন তৃণমূল পুরবোর্ডও। তবে, পুরপ্রধান পীযূষ পাণ্ডের দাবি, “পুকুর বুজিয়ে বাড়ি হচ্ছে না। তবে দু’চারটি ছোট ডোবা বোজানো হয়েছে। হ্যা, কিুছু ক্ষেত্রে পুকুরের পাড় সমতল করে বাড়ি বানানো হচ্ছে। সেটা বহু বছর ধরেই চলছে। যাঁরাই এ রকম বাড়ি বানাচ্ছেন, বেআইনি ভাবেই বানাচ্ছেন। পুরসভা ওই সব বাড়ির অনুমোদন দেয়নি।”
প্রশ্ন উঠেছে, ‘অনুমতি’ না দিলেও ওই সব তথাকথিত বেআইনি বাড়িগুলির জন্য পুরসভা পরিষেবার জোগান কেন দিচ্ছে? দেখা যাচ্ছে, পুকুর বা জলাশয়ের পাড় কেটে বা বুজিয়ে যে সব বসতবাড়ি তৈরি হচ্ছে, তার পাশ পুরসভা দিব্যি ব্যবহারের রাস্তা (তাও কংক্রিটের) তৈরি করে দিচ্ছে। জলের সংযোগ পৌঁছে দেওয়া হয়। এমনকী, সহজেই মিলে যায় বিদ্যুৎ সংযোগও। অনুমোদন না মেলার পরেও ওই সব বেআইনি বাড়ি কীভাবে যাবতীয় পুর পরিষেবা পেয়ে যাচ্ছে, তার কোনও সদুত্তর মিলছে না। এমনকী, ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর থেকেও এ ব্যাপারে কোনও বাধা দেওয়া হয়নি বলেই অভিযোগ। অথচ ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের পরিসংখ্যানই বলছে, বছর চল্লিশ আগে পুরসভার তকমা পাওয়া এই গঞ্জ শহরের চারিদিকে যে অজস্ব ছোটবড় পুকুর-জলাশয় ছিল, সেই সংখ্যাটি কমতে কমতে এখন আগের এক তৃতীয়াংশে দাঁড়িয়েছে। এলাকাবাসীর পর্যবেক্ষণ, যে গুটিকয়েক পুকুর এখনও বেঁচে রয়েছে, তার অধিকাংশই জমিদালালদের কবজায় কিংবা নজরে। বিভিন্ন উপায়ে সেগুলি ভরাট করা চলছে। ইতিমধ্যেই অনেক ছোট জলাশয় বুজিয়ে দেওয়া এবং পুকুরের পাড় কেনাবেচা সম্পন্ন। তবে, এখনও কিছু পুকুর রয়েছে, যেগুলি পুরসভা সংস্কার করলে এলাকার মানুষ উপকৃত হতেন। কিন্তু তা না করে বরং পুকুর ভরাটকারীদেরই প্রচ্ছন্ন মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পুরসভার বিরুদ্ধে। পুরপ্রধান যা-ই বলুন, বিরোধী কাউন্সিলর সিপিএমের শেখ আলাউদ্দিন বলছেন, “পুকুর চুরির এই কারবার গত এক দশক ধরে রমরমিয়ে চলছে। এই গোটা সময়টা পীযূষবাবুই দুবরাজপুরের পুরপ্রধান ছিলেন। তাঁর পুরবোর্ড এই বেআইনি কাজ রুখতে ব্যর্থ হয়েছে।”
কী ভাবে চলছে এই পুকুর-চুরি?
ছোট ছোট শিকারী পশুরদল সাধারণত বড় শিকারকে ঘায়েল করে তার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করে। তার পরেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তার দখল নেয়। রাজ্যের অন্য শহরগুলির মতোই দুবরাজপুরেও ঠিক এক প্রক্রিয়ায় চলছে পুকুর-চুরি। নাম গোপন রাখার শর্তে এ কাজে যুক্ত দালালচক্রের এক পাণ্ডা জানাচ্ছেন, দুবরাজপুর শহর দিন দিন কলেবরে বাড়ছে। গ্রামাঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ শহরে বসবাসের জন্য আসছেন। কিন্তু স্কুল, বাসস্ট্যান্ড, পুরসভা বা থানার কাছাকাছি আর খালি জমি নেই। অথচ সবাই এই সব কিছুর কাছেই নিজেদের বাড়ি চান। ওই পাণ্ডার দাবি, “তাই পুকুরপাড় এবং ছোট জলাশয়গুলিই নিশানা করা হয়েছে। একটি পুকুর পাড় কিনে যন্ত্র লাগিয়ে তা সমতল করে দিয়ে প্লট করে দিব্যি বেচে দেওয়া যায়। পকুর পাড়ে বাড়ি বানানোর অনুমতি থাকে না, সেটা ঠিক। কিন্তু পুকুর পাড় কেনাবেচা বা রেজিস্ট্রি করায় আইনগত কোনও বিধি নিষেধ নেই।” তিনি জানান, প্রথমেই দেখা হয় পুকুর বা জলায়শয়টির অংশীদারের সংখ্যা কত, তাঁদের নিজেদের মধ্যে মিল কতটা। যদি পারস্পরিক সম্পর্ক খারাপ থাকে, তাহলে পকুর পাড় কেনা অনেক সহজ হয়ে যায়। তা না হলে কাউকে জোর করে বা ভয় দেখিয়ে বা একটু বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে জমি কিনে নেওয়া হয়। তবে, খরচ যাই হোক, লাভের টাকা তুলতে কোনও সমস্যা হয় না বলেই তাঁর দাবি। ওই পাণ্ডার হিসেব অনুযায়ী, একটি একশো কাঠার পুকুর পাড় বিক্রি করে জমি কারবারিরা কমপক্ষে ১০ লক্ষ টাকা লাভ করেন। শহরে অবস্থানের নিরিখে লাভের অঙ্ক আরও কয়েক গুন বেড়ে যায়। কিন্তু এই টাকার খেলায় আইনগত বাধার পাশাপাশি নিজের এলাকার ইকো-সিস্টেম নষ্ট হয়ে পরিবেশের বিপদ যে বাড়ছে, তা নিয়ে প্রশাসনের কর্তারা কিছু ভাবেন কি?
পরিবেশবিদরা জানাচ্ছেন, অবশ্যই বিপদ বাড়বে। তাঁদের মত, শহরজুড়ে একে একে জলাশয় কমে গেলে জলের টান পড়বে। যত জলের টান পড়বে মানুষ তত ভূগর্ভস্থ জলের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হবেন। আর তখনই ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক বা ফ্লোরাইডের মতো বিষাক্ত পদার্থ মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। ক্ষতিগ্রস্থ হবেন মানুষই। অন্য দিকে, পুকুর পাড়ে থাকা বসতবাড়ি থেকে নির্গত নোংরা জল পুকুরের জলকে দূষিত করবে। কাপড়জামা কাচার জন্য ব্যবহৃত ডিটারজেন্ট জলে মিশলে কচুরিপানার মতো জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধি হবে। জলে অক্সিজেনের পরিমাণও কমবে। এর ফলে জলে বসবাসকারী জীবের মৃত্যু ঘটবে। গোটা খাদ্য শৃঙ্খলটাই বিপর্যস্ত হবে। জীব বৈচিত্র্য নষ্ট হবে। নাব্যতা কমে অচিরেই পুকুরটি মজে যাবে। তার উপর রয়েছে নিকাশির সমস্যা। শহরের বিভিন্ন নিকাশি নালার শেষ প্রান্ত বিভিন্ন পুকুরের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এর ফলে শহরের নোংরা জল সরাসরি পুকুরে এসে মিশছে। তার উপর পুকুর পাড়ের বাড়িগুলির নিকাশি নালার জল পুকুরে মিশে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। যার জেরে এলাকায় জলবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়বে বলেই পরিবেশবিদদের আশঙ্কা।
পুকুর নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি অবশ্য পুরপ্রধান মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, “শহরে এখন ১১৭টি পুকুর রয়েছে। গত আর্থিক বর্ষেই ১০-১২টির সংস্কারও করা হয়েছে। নিকাশি নালার শেষ প্রান্ত যাতে পুকুরে গিয়ে শেষ না হয়, তা নিয়েও ভাবনা-চিন্তা করছি। নিকাশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতেও টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আশা করছি সমস্যা মেটানো যাবে।” তাঁর এই আশ্বাসের পরেও অবশ্য বাসিন্দারা কোনও আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না। উল্টে, এ নিয়ে পুরপ্রশাসনের গাফিলতিই তাঁদের বেশি করে নজরে পড়ছে। শহরের প্রবীণ নাগরিক রবীন্দ্রনাথ কবিরাজের দাবি, “দেখতে দেখতে একটার পর একটা পুকুর ডোবা বুজিয়ে দেওয়া হল। পুকুর পাড়ে বাড়ি তৈরি চলছেই। দিন কয়েক আগে সম্পূর্ণ বিনা বাধাতেই বাজারের মধ্যে থাকা ইন্দিরা মার্কেট ভবনের পিছনের দিকে একটি ডোবা ভরাট করা হল। খোদ পুরপ্রধানের বাড়িটাই তাঁতি ডোবা নামে একটি পুকুর ভরাট করে করা।” পীযূষবাবু অবশ্য একে ‘ভিত্তিহীন অভিযোগ’ বলেই দাবি করেছেন। তাঁর পাল্টা দাবি, “বহু আগেই দুবরাজপুর শহরে এই কারবার শুরু হয়েছে। তখনও কেউ বাধা দেয়নি। উল্টে ব্লক প্রশাসনের তরফে এলাকার বিধায়ক এবং সাংসদ কোটার টাকায় পুকুর বুজিয়ে শহরের দু’টি বড় ক্লাবকে বাড়ি তৈরি করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কই, তখন তো কেউ প্রশ্ন তোলেননি!”
রাজনৈতিক তরজায় বিরক্ত পুরবাসী। দুবরাজপুর নাগরিক সমিতির সম্পাদক তথা চিকিৎসক শ্যামাপ্রসাদ মিশ্র বলছেন, “বাম বা ডান কোন সময় থেকে পুকুর পাড় কেটে বা জলাশয় ভরাট করে বাড়ি তৈরির প্রবণতা বেড়েছে, এই বিতর্কে যাচ্ছি না। তবে, চোখের সামনে একটার পর একটা জলাশয় শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যাঁরা এটা রোখার দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁরাই চোখ বুজে রয়েছেন।” তাঁর খেদ, “দুবরাজপুর থানার সামনেই যে পুকুরটা এখনও টিকে রয়েছে, দেখতে দেখতে সেটাও একদিন হারিয়ে যাবে। আসলে মানুষ মিলিত প্রতিবাদ না করলে এই জিনিস বন্ধ করা মুশকিল।”
কেমন লাগছে আমার শহর? আপনার নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-বীরভূম’।
অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’, বীরভূম বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১