লাভপুর-গুনুটিয়ার মাঝে ভগ্নপ্রায় সেতু। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি
রাজ্য সরকারেরই দুই দফতর। আর তাদেরই টানা-পোড়েনে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বেহাল দশা ঘুচছে না জেলার কয়েক দশকের পুরনো বহু জরাজীর্ণ সেতুর। অথচ সেচখালের উপরে নির্মিত ওই সব সেতুর এলাকায় গুরুত্ব কম নয়। অভিযোগ, সেতু সংস্কারের ব্যাপারে সেচ ও পূর্ত (সড়ক) দফতর ক্রমাগত একে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছে। দুই দফতরের বিবাদে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন জেলার অসংখ্য মানুষ। ক্ষুব্ধ বাসিন্দাদের দাবি, বারবার সমস্যার সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরে আবেদন জানালেও প্রশাসনের হেলদোল নেই।
পূর্ত (সড়ক) দফতর বিভিন্ন সময় জেলার সড়কগুলির সংস্কার কিংবা পুনর্নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওই একই রাস্তার উপর থাকা সেচ দফতরের তৈরি সেতুগুলির কোনও সংস্কার করেনি। এমনকী, ব্যবস্থা নেয়নি সেচ দফতরও। কেন? পূর্ত (সড়ক) দফতরের যুক্তি, সেতুগুলি তৈরি করেছে সেচ দফতর। তাই সংস্কার বা নতুন করে তা তৈরির দায়িত্ব ওই দফতরেরই। অন্য দিকে, সেচ দফতরের পাল্টা যুক্তি, সেতু তারা নির্মাণ করেছে ঠিকই। কিন্তু ওই সব সেতুর উপর দিয়ে পূর্ত (সড়ক) দফতর অনুমোদিত যানবাহনই চলাচল করে। এর জন্য ওই দফতর পরিবহণ করও তোলে। সুতরাং সেতু সংস্কার এবং নতুন করে নির্মাণের দায়িত্ব রাজ্যের পূর্ত (সড়ক) দফতর এড়িয়ে যেতে পারে না।
দুই দফতরের কর্তাদের এই চাপান-উতোরেই বছরের পর বছর বেহাল হয়ে পড়ে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সংলগ্ন, সেচখালের উপর নির্মিত বহু সেতু। বাসিন্দারা বাঁশ, মাটি দিয়ে নিজেরাই সেতু সংস্কার করে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। জোড়াতালি দিয়ে সংস্কার করা ওই সব সেতু দিয়েই যাতায়াত করছে ভারী ট্রাক, যাত্রীবাহী বাস-সহ সমস্ত রকমের যানবাহন। এই পরিস্থিতিতে কোথাও সেতুর বেহাল দশার কারণে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কোথাও ঘুরপথে যাতায়াত করছে যানবাহন। অহেতুক সময় এবং টাকা ব্যয় করে তাঁদের নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে। অথচ সমস্যার সমাধানে প্রশাসনের দিক থেকে কোনও পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না বলেই স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ। যেমন, ময়ূরাক্ষী সেচখালের উপরেই সেচ দফতর নির্মিত একটি সেতু রয়েছে। বছর খানেক আগে সেটি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। কিন্তু সেচ দফতর বা পূর্ত (সড়ক) দফতর, কেউ-ই ওই সেতু সংস্কার কিংবা পুনর্নির্মাণে উদ্যোগ নেয়নি। গ্রামবাসীদের জোড়াতালিতেই সেতু দিয়ে কোনও রকমে প্রাণ হাতে সাইকেল, মোটরবাইক নিয়ে যাতায়াত চলছে। কিন্তু বাস-সহ বড় গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ। রুটের বাসগুলি বর্তমানে সনকপুর গ্রামের সঙ্কীর্ণ রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছে। রাস্তার বেহাল দশার কারণে সেই চলাচলও হামেশাই অনিয়মিত হয়ে পড়ছে।
বেশি সমস্যায় পড়ছে ছাত্রছাত্রীরা। মল্লারপুর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী পাখুরিয়ার অমৃতা মণ্ডল, ভগীরথপুরের সুস্মিতা দাসরা বলেন, “আমাদের গ্রামের কাছের রাস্তা দিয়ে যখন বাস যেত, তখন কলেজে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে সকাল ১০টায় বের হলেও চলত। কিন্তু সেতু ভেঙে যাওয়ায় ৯টাতেই বাড়ি থেকে বেরনোর তোড়জোড় শুরু করতে হয়। ৩-৪ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে শিবগ্রামে এসে কলেজে যাওয়ার বাস ধরতে হয়।” ফলে পড়ার সময় কমে যায় অমৃতাদের। সময়ের অভাবে বাড়িতে সব দিন খাওয়াও হয় না। সমস্যায় পড়েন কৃষিজীবীরাও। ভগীরথপুরেরই সুশান্ত দে, অবিনাশ মণ্ডলেরা বলছেন, “গরুর গাড়িতে কৃষিজাত পণ্য নিয়ে আমাদের শিবগ্রাম, বীরচন্দ্রপুর, ময়ূরেশ্বরের হাট-বাজারে যেতে হয়। আবার ওই সব জায়গা থেকে রাসায়নিক সার-সহ নানা প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে আসতে হয়। কিন্তু সেতু ভেঙে যাওয়ায় এখন বিস্তর ঘুরপথে বাজার-হাটে যেতে হচ্ছে।” সুশান্তবাবুরা ঘাড়ে বা মাথায় করে ভারী ভারী বোঝা বইতে বাধ্য হন। বাজারে পৌঁছতেই বহু সময়ে লেগে যায়। তত ক্ষণে চাহিদা কমে যাওয়ায় নামমাত্র মূল্যে সব কিছু বেচে তাঁদের লোকসান গুনতে হয়।
একই চিত্র গুনুটিয়া-লাভপুর, রোঙ্গাইপুর-সাংড়ার মতো জেলার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সড়কেরও। বছর দু’য়েক আগে জেলা পূর্ত (সড়ক) দফতর গুনুটিয়া-লাভপুর রাস্তা সংস্কার করে। কিন্তু সড়কেই শ্যাওড়াগড়ে মোড় সংলগ্ন সেচখালের সেতুটি ভেঙে পড়ে রয়েছে। সেতুর পাশ দিয়ে অস্থায়ী চলাচলের ব্যবস্থা করা হলেও বর্ষায় সেচখালের জলে তা তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, সেচ এবং সড়ক দফতর সেতুটির পুনর্নির্মাণের ব্যাপারে সমান উদাসীন। দাঁড়কার কাশীনাথ কোনাই, আবাডাঙার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়েরা বলেন, “সেতু পুনর্নির্মাণের দাবি নিয়ে সড়ক দফতরে গেলে তাঁরা সেচ দফতরকে দেখাচ্ছে, আর সেচ কর্তারা আমলই দিচ্ছেন না। অথচ অস্থায়ী সেতু একবার ভেঙে পড়লেই বিস্তীর্ণ এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে কারও কোন হেলদোলই নেই।” একই অভিযোগ সাঁইথিয়ার মাঠপলশা পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দাদেরও। ২০০৭-’০৮ আর্থিক বর্ষে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় স্থানীয় রোঙ্গাইপুর থেকে সাংড়া পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ওই রাস্তার উপরেই মহিষাডহরী হল্টের কাছে সেচখালে ১৯৫০ সালে সেচ দফতরের নির্মিত ভগ্নপ্রায় সেতুটি আজও সংস্কারের কোনও ব্যবস্থা হয়নি। অথচ ওই সেতুর উপর দিয়েই প্রাণ হাতে করে যাতায়াত করতে হয় এলাকার বাসিন্দাদের। মাঠপলশা পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তৃণমূলের মহম্মদ ইউনিস বলেন, “সেতু ভেঙে শুধু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াই নয়, যে কোনও সময় দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটতে পারে।”
জেলা পূর্ত (সড়ক) দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার অজিত সিংহের স্পষ্ট বক্তব্য, “সেচখালের উপর সেতু নির্মাণের দায়িত্ব সেচ দফতরের। ওই সব সেতু সংস্কার কিংবা পুনর্নির্মাণের বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যেই সেচ দফতরের দৃষ্টি আর্কষণ করেছি। তবে, তারা যদি না পারেন, তা হলে আমরাই যথাযথ উদ্যোগ নেব।” অন্য দিকে, জেলা সেচ দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার সুজিত কোনার অবশ্য বলছেন, “শুধু মাত্র ওই সেতুগুলিই নয়, জেলায় বর্তমানে ৩২টি সেতুর পুনর্নির্মাণ জরুরি। কিন্তু টাকার অভাবে কাজে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আর্কষণ করা হয়েছে। টাকা বরাদ্দ হলেই কাজ শুরু হবে।” পরিস্থিতির কথা জেনে জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ আব্দুল করিম খানের আশ্বাস, দুই দফতরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে দ্রুত সম্ভব সেতুগুলির হাল ফেরানো হবে।