ডাইনি অপবাদে স্কুলে যাওয়া বন্ধ, এখনও ভয় কাটেনি বালিকার

ঠাকুমা, মায়ের পরে ডাইনি অপবাদ দিয়ে সাত বছরের বালিকাকেও হেনস্থার অভিযোগ উঠল আদিবাসী-প্রধান গ্রামের মাতব্বরদের বিরুদ্ধে। পুরুলিয়ার বোরো থানার বড়গড়া গ্রামের ঘটনা। ওই দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রীর পরিবারের কাছে জানগুরুর নির্দেশমতো পুজো করতে মোটা টাকা চাওয়া হয় বলেও অভিযোগ।

Advertisement

সমীর দত্ত

বান্দোয়ান শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৪ ০১:৫২
Share:

ঠাকুমা, মায়ের পরে ডাইনি অপবাদ দিয়ে সাত বছরের বালিকাকেও হেনস্থার অভিযোগ উঠল আদিবাসী-প্রধান গ্রামের মাতব্বরদের বিরুদ্ধে। পুরুলিয়ার বোরো থানার বড়গড়া গ্রামের ঘটনা। ওই দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রীর পরিবারের কাছে জানগুরুর নির্দেশমতো পুজো করতে মোটা টাকা চাওয়া হয় বলেও অভিযোগ। ভয় পেয়ে মেয়েটিকে নিয়ে গ্রাম ছাড়েন তার মা। খবর পেয়ে পুলিশ বাড়িতে পিকেট করায় ১০ দিন পরে, মঙ্গলবার বাড়ি ফিরলেন মা-মেয়ে।

Advertisement

পরিবারটির করা অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ গ্রামের সাত বাসিন্দার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তবে কেউ গ্রেফতার হয়নি। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “ওই বাড়িতে আপাতত বেশ কিছু দিন পুলিশ-পিকেট থাকবে। গ্রামবাসীদেরও বোঝানো হচ্ছে।”

বোরো থানা থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরের বড়গড়া গ্রাম রীতিমতো প্রত্যন্ত এলাকায়। গ্রামবাসীর মূল জীবিকা চাষবাস। গ্রামে ঢোকার রাস্তা আজও কাঁচা। সবচেয়ে কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে, বান্দোয়ানে। সবচেয়ে কাছের স্কুল পাঁচ কিলোমিটার দূরে, চিরুডিতে। স্থানীয় সূত্রের খবর, বাসিন্দাদের ২০ শতাংশের বেশি সাক্ষর নন।

Advertisement

গ্রামে ডাইনি অপবাদ নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু হওয়ায় বান্দোয়ানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে সাত বছরের মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার মা। তাঁর দাবি, বছর চারেক আগে তাঁর শাশুড়িকে গ্রামের মাতব্বরেরা ডাইনি অপবাদ দিয়েছিল। মাসখানেক আগে তাঁকেও ডাইনি অপবাদ দেওয়া হয়। প্রশাসনকে জানানোয় প্রথম দু’বার বড় কোনও গোলমাল হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি তাঁর ছোট্ট মেয়েটাকে অপবাদ দেওয়া শুরু হওয়ায় ঘর ছাড়তে বাধ্য হন।

তাঁর স্বামী জানান, ১ জুলাই তাঁদের মেয়ের সঙ্গে খেলা করার সময় এক পড়শির ছেলে অজ্ঞান হয়ে যায়। ওই যুবকের ক্ষোভ, “তখন গ্রামের কিছু লোক রটিয়ে দেয় আমার মেয়ে ডাইনি। স্কুলে সহপাঠীরা ওর সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। সবাই ওকে ‘ডাইনি’ বলে ডাকতে শুরু করে। স্কুলে পাঠানো বন্ধ করতে হয়।” তিনি জানান, গ্রামের মাতব্বরেরা সালিশি সভা করে নির্দেশ দেন, স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে বোকারোয় জানগুরুর কাছে যেতে হবে। গ্রাম থেকেও অনেকে সেখানে যাবেন ও তাঁদের যাতায়াতের খরচও পরিবারটিকে দিতে হবে।

চাপের মুখে জানগুরুর কাছে গিয়েছিল পরিবারটি। তবে সেই জানগুরু নিদান দেন, মোটা টাকা খরচ করে গ্রামের বাড়িতে পুজো করার। বালিকার মা বলেন, “স্বামীর সামান্য জমিতে চাষ। অত টাকা আমাদের নেই। গ্রামের লোকের ব্যবহারও বদলে গিয়েছিল। ভয় পেয়ে মেয়েকে নিয়ে গ্রাম ছাড়ি।” ১৮ জুলাই গ্রাম ছাড়ার সময় বধূটি বোরো থানায় পুলিশের কাছে অভিযোগ জানান। পুলিশ দু’পক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা শুরু করে। খবর পেয়ে ২৫ জুলাই গ্রামে যান ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’-র সদস্যেরা। সমিতির তরফে বিপ্লব দাস বলেন, “গ্রামবাসীদের বলেছি, ডাইনি বলে কিছু হয় না। সে অপবাদ দিয়ে জরিমানা করা আইনত অপরাধ। এর জেরে একটা বাচ্চার লেখাপড়া বন্ধ হতে বসেছে। এটা ঠিক নয়।” রবিবার রাত থেকে ওই বাড়িতে পুলিশ-পিকেট বসে। এ দিন বিকেলে মায়ের হাত ধরে গ্রামে ফেরে বালিকাটি। তার বক্তব্য, “আমাকে আর কেউ কিছু বলবে না তো?”

কী বলছেন গ্রামের মাতব্বরেরা? অভিযুক্ত অজিত টুডু, চুনারাম হাঁসদারা দাবি করেছেন, “অতটুকু মেয়েকে কি আমরা ডাইনি বলতে পারি? তবে জানগুরু বলেছিলেন, ওদের বাড়িতে পুজো করা দরকার। পুজো দিলে, ওরা মনে হয় ভাল করত।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement