জলবন্দি রামপুরহাট জেরবার জঞ্জালে

ছোটবেলাটা কেটেছে এই শহরে। তার পরে কলকাতার দিকে কলেজে পড়ার সময়ে ছুটিছাটায় বাড়ি ফেরা। এমএসসি-র ছাত্র অরিত্র সাহার এই ফেরার আনন্দ কিন্তু দু’দিনেই মাটি হয়ে যায় শহরের আবর্জনাময় ঘিঞ্জি রাস্তায়। একটি সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কর্মরত সৌমেন মণ্ডল এখন থাকেন কোচবিহার শহরে। আশপাশটা পাল্টে যেতে দেখছেন।

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

রামপুরহাট শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৪ ০২:১৩
Share:

ছোটবেলাটা কেটেছে এই শহরে। তার পরে কলকাতার দিকে কলেজে পড়ার সময়ে ছুটিছাটায় বাড়ি ফেরা। এমএসসি-র ছাত্র অরিত্র সাহার এই ফেরার আনন্দ কিন্তু দু’দিনেই মাটি হয়ে যায় শহরের আবর্জনাময় ঘিঞ্জি রাস্তায়।

Advertisement

একটি সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কর্মরত সৌমেন মণ্ডল এখন থাকেন কোচবিহার শহরে। আশপাশটা পাল্টে যেতে দেখছেন। বাড়ি ফিরলেই মনে হয়, তাঁর পুরনো শহর যেন বড্ড দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। কিন্তু তবু তাঁর চোখে ধরা পড়ে, শহরে পানীয় জলের সমস্যাটা তো সেই আগের মতোই রয়ে গিয়েছে।

রামপুরহাট শহরের দিকে দিকে একের পর এক গড়ে উঠছে বহুতল আবাসন। আগের তুলনায় শহরের পরিধিও বাড়ছে। একাধিক নির্মাণ সংস্থা ব্যবসার জন্য বেছে নিচ্ছেন এই শহরকেই। জমির চাহিদাও তুঙ্গে। এক এক করে নানা বড় সংস্থাও শো-রুম খুলছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বস্ত্র, গয়নার দোকানে গিয়ে কেনাকাটা, দিনের শেষে সন্ধ্যায় নানা জায়গায় আড্ডা-বিনোদন, রাতে রেস্তোরাঁয় খাওয়া সেরে বাড়ি ফেরায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে এই শহর।

Advertisement

শহরের এই চকচকে মুখের পিছনে একটা গভীর অন্ধকারও রয়েছে। এক জন পুর নাগরিক হিসেবে পানীয় জল-নিকাশি-সাফাইয়ের মতো যে মৌলিক পরিষেবাগুলি পুরসভার কাছ থেকে মেলার কথা, তা ঠিকমতো পৌঁছচ্ছে না বলেই অভিযোগ। সিংহভাগ বাসিন্দার ক্ষোভ, এই শহরে ইট-কাঠ-পাথরের আভিজাত্য বাড়লেও পুর পরিষেবার হাল সেই মান্ধাতার আমলেই পড়ে রয়েছে। তাই তিরিশ বছর আগেও এই শহরের পুরপরিষেবা নিয়ে যে সব সমস্যা ছিল, আজও তার চেহারায় এতটুকুও বদল ঘটেনি।

রাস্তাঘাটের উন্নতি না হওয়ায় এই শহরের একটি বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গিয়েছে যানজট। দীর্ঘদিন উপযুক্ত সংস্কার না হওয়ায় বিভিন্ন রাস্তা খানা-খন্দে ভরে রয়েছে। বর্ষায় জল জমে যা আরও ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। ছোটখাটো দুর্ঘটনাও ঘটছে। এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলির প্রশস্ত নয়। তার উপর যানজটের মার। শহরের মহাজনপট্টি-কামারপট্টি, দেশবন্ধু রোড, ব্যাঙ্ক রোড, ডাকবাংলা মোড় এলাকায় দিনভর যানজটে অতিষ্ট মানুষজন। যখন-তখন মালবোঝাই গাড়ি ঢোকা-বেরোনো, যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা, পণ্য তোলা-নামায় লাগাম না পরানোর ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। পথচারীর যন্ত্রণা বাড়িয়েছে জবরদখল হয়ে যাওয়া ফুটপাথ এবং যত্রতত্র অবৈধ পার্কিংও। দুমকা রোড, দেশবন্ধু রোড, ব্যাঙ্ক রোডের দু’পাশ বেআইনি দখলদারির জেরে রাস্তা আরও সরু হয়ে গিয়েছে। আর শহরের গতি নিয়ন্ত্রণের কারিগর ট্রাফিকিং ব্যবস্থা যেন নিধিরাম সর্দার!

শহরবাসীর বছরভর দুর্ভোগের একটা বড় কারণ পুরসভার বেহাল নিকাশি ব্যবস্থা। রাস্তায় যেখানে-সেখানে জঞ্জাল পড়ে থাকে। নিয়মিত সাফাইও হয় না। বিশেষ করে বর্ষায় শহরবাসীকে প্রমাদ গুনতে হয়। সামান্য বৃষ্টিতেই জাতীয় সড়কে মাড়গ্রাম মোড়, বাসস্ট্যান্ড এলাকা, লোটাস প্রেস মোড়, ছ’ফুঁকো, চাকলা মাঠ এলাকার রাস্তা জলের তলায় চলে যায়। তার বেশি বৃষ্টি হলেই আজও ছ’ফুঁকো এলাকার জমা জলের জেরে জলবন্দি হয়ে পড়ে শহরের পাঁচটি ওয়ার্ডের (১ ,২, ৩ , ১৭ ও ১৬) বাসিন্দা। নিকাশি নিয়ে নতুন করে ভুগতে শুরু করেছে ৯, ১০ ও ১১ নম্বর ওয়ার্ডও। অভিযোগ, লোটাসপ্রেস ও কামারপট্টি মোড় এলাকার নিকাশি সমস্যা দূর করতে গিয়ে ওই তিনটি ওয়ার্ডের নিকাশি ব্যবস্থার উপর আঘাত হানা হয়েছে। এ বার বর্ষায় ওই সব ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের জলবন্দি দিন কাটানোর নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে।

পুরশহরের বেহাল নিকাশি ব্যবস্থার মূলে রয়েছে এলাকায় নিয়মিত ভাবে রাস্তাঘাট, নর্দমায় জমা জঞ্জাল সাফাইয়ে পুরসভার ব্যর্থতা। শহরে সদ্য একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন পেশায় চিকিত্‌সক হিরন্ময় ঘোষ। তাঁর অভিজ্ঞতা, “শহরে ঢুকছি, দেখছি সানঘাটা সেতু সংলগ্ন এলাকায় জাতীয় সড়কের ধারে জঞ্জালের পাহাড়। শহরের ভিতরেও এক চিত্র। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ লাগোয়া এলাকায় জঞ্জালের গন্ধে মানুষের টেকা দায়। বড় হাটতলা বাজার এলাকাতেও জঞ্জালের স্তূপ।” অথচ জনগণের করের টাকায় কেনা ৩৫ লক্ষ টাকার দু’টি আধুনিক সাফাই যন্ত্র পুরসভার ঘরে পড়ে থেকে পচতে বসেছে।

সমস্যা রয়েছে পানীয় জলেরও। বছরভর পানীয় জল পেতে সমস্যায় ভোগেন নাগরিকেরা। পুরসভার নতুন জলপ্রকল্পের উদ্বোধন হয়ে যাওয়ার পরেও সমস্যা সেই আগের তিমিরেই রয়ে গিয়েছে। পুর এলাকায় এখনও এমন বহু এলাকা রয়েছে, যেখানে নিয়মিত পর্যাপ্ত জল পৌঁছয় না। ৮, ৯, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের ক্ষোভ, তাঁদের এলাকার বহু অংশে এখনও পানীয় জলই ঢোকে না। নতুন পাইপ লাইনগুলির সংযোগের ক্ষেত্রে আবার পর্যাপ্ত জল না মেলার অভিযোগ রয়েছে। এমনকী, শহরের পুরনো এলাকাতেই এমন বহু জায়গা রয়েছে, যেখানে এখনও পাইপ লাইনই পৌঁছয়নি। কিছু কিছু এলাকায় দিনে মাত্র একবারই জল আসে বলে অভিযোগ। শহরের বহু এলাকাতেই জলের গতিবেগও কম। পুরসভার ট্যাপকল দিয়ে জল পড়ে পড়ে নষ্ট হয়। সে দিকেও পুরসভার নজরদারি নেই বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ।

দু’বছর আগে ঘটা করে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা খরচ করে শহরের দেশবন্ধু রোডে ও ব্যাঙ্ক রোডে ত্রিফলা বাতি লাগানো হয়েছিল। গত ছ’মাস ধরে সব ক’টিই খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে। সারানোর নাম নেই। ফলে ওই এলাকা তো বটেই শহরের বহু এলাকা এখনও সন্ধ্যা নামতেই অন্ধকারে ডুবে যায়। কারণ সব:ত্র পথবাতির ব্যবস্থা নেই। অন্ধকারের সুযোগে বেশ কিছু রাস্তায় চলে জুয়া খেলা, নানা অসামাজিক কাজ। উদ্বেগ নিয়েই বাসিন্দাদের ওই সব রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করতে হয়।

কখনও প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার, কখনও অবৈধ দখলদারি, আবার কখনও বাসিন্দাদের দিক থেকে বাধাকে দুষেই হাত তুলেছে পুরসভা। এই ভোট-ব্যাঙ্কের রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে শহরটাকে আসল সমস্যা থেকে বের করার উপায় কী, তার উত্তরটাই খুঁজছে রামপুরহাট।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement