জখম নেতার লড়াই শেষ সাত মাসে

দলীয় কর্মীদের মার খেতে দেখে তিনি এগিয়ে যান। দুষ্কৃতীদের বোঝানোর চেষ্টাও করেছিলেন। জবাবে জুটেছিল রডের মার। আরও অভিযোগ, রাস্তায় ফেলে ওই বৃদ্ধের গায়ের উপর দিয়ে একাধিক বার মোটরবাইকও চালানো হয়েছিল। সাত মাসের আগের ওই ঘটনায় গুরুতর জখম জেলার প্রবীণ সিপিএম নেতা হীরেন্দ্রনাথ ঘোষের (৭২) মৃত্যু হল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বোলপুর শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০৪
Share:

প্রয়াত সিপিএমের প্রবীণ নেতা হীরেন্দ্রনাথ ঘোষকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন নিমাই দাস।

দলীয় কর্মীদের মার খেতে দেখে তিনি এগিয়ে যান। দুষ্কৃতীদের বোঝানোর চেষ্টাও করেছিলেন। জবাবে জুটেছিল রডের মার। আরও অভিযোগ, রাস্তায় ফেলে ওই বৃদ্ধের গায়ের উপর দিয়ে একাধিক বার মোটরবাইকও চালানো হয়েছিল। সাত মাসের আগের ওই ঘটনায় গুরুতর জখম জেলার প্রবীণ সিপিএম নেতা হীরেন্দ্রনাথ ঘোষের (৭২) মৃত্যু হল।

Advertisement

মাসখানেক আগে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে এত দিন বোলপুরের বাড়িতেই তাঁর চিকিত্‌সা চলছিল। সোমবার গভীর রাতে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। মঙ্গলবার সকালে বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে তাঁর দেহের ময়না-তদন্ত হয়েছে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “দুষ্টের দমন করে রাজধর্ম পালন করা পুলিশের কাজ। কিন্তু পুলিশ এখন জনগণের হয়ে নয়, তৃণমূল দলের হয়ে কাজ করছে। পুলিশের এই নিষ্ক্রিয়তাই হীরেন্দ্রনাথবাবুর মতো মানুষের মৃত্যুর জন্য সব থেকে বেশি দায়ী। খুনিদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে আমরা সর্বস্তরে প্রতিবাদে সামিল হবো।”

প্রসঙ্গত, লোকসভা ভোটের সময় গত ৯ এপ্রিল বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের সভার জন্য দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে প্রচারে বেরিয়েছিলেন জেলার বর্ষীয়ান এই সিপিএম নেতা। বোলপুরের সর্পলেহনা-আলবাঁধা পঞ্চায়েতের রতনপুরের কাছে তাঁদের গাড়িতে তৃণমূলের লোকেরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ। হীরেন্দ্রনাথবাবুকে মারধর করা হয়। জখম হন সিপিএমের পাঁচ জন। হীরেন্দ্রনাথবাবু-সহ দু’জনের আঘাত গুরুতর হওয়ায় তাঁদের প্রথমে বোলপুর ও পরে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখান থেকে তাঁকে প্রথমে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। শয্যা পাওয়া গেলেও ভেন্টিলেশন মেলেনি। তাই এম আর বাঙুরে যোগাযোগ করা হয়। সেখানেও একই সমস্যা দেখা দেওয়ায় শেষমেষ বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। রাজনৈতিক সৌজন্য দেখিয়ে এ ব্যাপারে তখন ওই সিপিএম নেতার পরিবারকে সাহায্য করেছিলেন তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল।

Advertisement

শোকমিছিল।

ওই ঘটনায় প্রথম থেকেই অবশ্য নাম জড়িয়েছিল পাড়ুইয়ে সাগর ঘোষ খুনের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত, স্থানীয় যুব তৃণমূল নেতা মহাদেব রায়ের। যিনি আবার অনুব্রত-অনুগামী হিসাবেই পরিচিত। ঘটনার পরে তৃণমূলের কঙ্কালীতলা অঞ্চল সভাপতি মহাদেব রায়, বাহাদুর ঘোষ-সহ শাসক দলের ছয় নেতা-কর্মীর নামে এফআইআর হয়। জেলার পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, “ওই ঘটনায় পুলিশ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছিল। এক অভিযুক্ত হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পেয়ে যান।” আগাম জামিন পেয়েছেন তৃণমূল নেতা মহাদেব রায়। বাকিরা বর্তমানে জামিনে মুক্ত বলে পুলিশ জানিয়েছে। অবশ্য ক্ষোভ কমেনি সিপিএম নেতৃত্বের। এ দিন বোলপুর পুরসভা সংলগ্ন দলীয় শাখা কার্যালয়ে হীরেন্দ্রবাবুকে শেষশ্রদ্ধা জানানোর সময়ে ক্ষোভ উগরে দেন সিপিএম-এর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সমীর ভট্টাচার্য। তাঁর অভিযোগ, “তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের পৈশাচিক মারে হীরেন্দ্রনাথবাবুর মৃত্যু হল। এই খুনের ঘটনায় শাসক দলের স্থানীয় নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিল। পুলিশ প্রথমে তাদের ধরতে চায়নি। পরে চাপে পরে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়।” তাঁর এবং সিপিএমের বোলপুর জোনাল সম্পাদক উত্‌পল রুদ্রের দাবি, এ বার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে খুনের মামলা রুজু করুক।

স্থানীয় সূত্রের খবর, অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক হীরেন্দ্রনাথবাবু অবিবাহিত ছিলেন। এলাকায় নির্বিবাদী মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। যে কোন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীর সঙ্গে সহজেই মিশে যেতেন। এলাকার সমাজসেবী হিসেবে সব দলের কাছেই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা যে ছিল তা মেনে নিচ্ছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীরাও। এ দিন দুপুরে ময়না-তদন্তের পরে এলাকার হাজারখানেক দলীয় কর্মী-সমর্থক এবং সাধারণ মানুষ হীরেনবাবুর দেহ নিয়ে শোক মিছিল করে শহরের তিনটি দলীয় কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে বহু মানুষ মৃত নেতাকে শেষশ্রদ্ধা জানাতে আসেন। এ দিন বোলপুরের হরগৌরী তলায় দলীয় কার্যালয়ে হীরেন্দ্রনাথবাবুকে শেষশ্রদ্ধা জানাতে হাজির হতে দেখা গেল স্থানীয় বিজেপি নেতা নিমাই ঘোষ, কংগ্রেস নেতা তপন সাহা, মহম্মদ জাহাঙ্গির হোসেনদেরও। নিমাইবাবু বলেন, “হিরুদা বিরোধী রাজনীতি করলেও খুব ভাল মনের মানুষ ছিলেন। সবাইকে সমান ভাবে দেখতেন। নিঃস্বার্থে সবার পাশে দাঁড়াতেন। তাঁর সঙ্গে কেউ এ রকম করবে, ভাবতে পারছি না।” যদিও কোথাও-ই তৃণমূলের কোনও নেতা-কর্মীকে দেখা যায়নি। এ দিনই বোলপুরের সতীঘাট শ্মশানে হীরেন্দ্রনাথবাবুর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। পরে তাঁর ভাইপো পার্থ ঘোষ বলেন, “আমরা এক জন অভিভাবককে হারালাম।”

কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে সাহায্য করে অন্য রকম ভূমিকা নিয়েছিলেন অনুব্রত। কিন্তু তাঁকে বা তাঁর দলের কোনও ছোটবড় নেতাকে এ দিন হীরেন্দ্রনাথবাবুর শেষযাত্রায় দেখা যায়নি। এ নিয়ে বারবার যোগাযোগ করা হলেও ফোন ধরেননি অনুব্রত। এক বার তাঁর কোনও এক অনুগামী ফোন ধরে বলেন, “দাদা মিটিংয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।” হীরেন্দ্রনাথবাবুর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ তথা বোলপুরের প্রাক্তন সাংসদ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “সকলের কাছে ওঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল। উনি নোংরা আর হিংসার রাজনীতির শিকার হলেন। রাজনীতিতে নীতির লড়াই হওয়া উচিত। মারামারি, হিংসা, প্রাণে মেরে ফেলা এ সব কী! হিরুবাবুর মতো নির্জলা এক জন মানুষকে এ ভাবে মরতে হবে, ভাবতে পারছি না।”

মঙ্গলবার ছবি দু’টি তুলেছেন বিশ্বজিত্‌ রায়চৌধুরী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement