শাসক দলের নেতা তো তিনি বটেই। কিন্তু, তিনি প্রশাসনের অঙ্গও। জেলা পরিষদের মাথায় বসে আছেন তিনি। সেই অরূপ চক্রবর্তী কী করে দলীয় কর্মীদের ‘ঘরে ঢুকলে কেটে দেওয়ার’ নির্দেশ দিলেন, তা বুঝতে পারছে না বাঁকুড়ার রাজনৈতিক মহল। সাধারণ মানুষেরও প্রশ্ন, খোদ জেলা সভাধিপতিই যদি বিরোধী কর্মীদের ‘খুন করার’ পরামর্শ দেন, তা হলে তাঁদের নিরাপত্তা কে দেবে?
সোমবার বাঁকুড়া সদর থানার মান্যডি গ্রামে গিয়ে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের পরিবারের মহিলাদের সঙ্গে কথা বলার সময় বিরোধীদের কেটে দেওয়ার এবং বলিদান দেওয়ার নির্দেশ দেন। অরূপবাবু দাবি করছেন, তিনি অন্যায় কিছু বলেননি এবং তাঁর বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। কিন্তু, তাঁর এই মন্তব্য ঘিরে জেলার রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধীরা বলছেন, অরূপবাবু জেলা প্রশাসনের শীর্ষ পদে বসে থেকে এবং নিজে এক জন আইনজীবী হয়েও এমন কথা বললেন কী করে।
বিজেপি-র রাজ্য সহ সভাপতি সুভাষ সরকার সভাধিপতির পদ থেকে অবিলম্বে অরূপবাবুর অপসারণ দাবি করে বলেন, “আমি ফোন করে পুলিশ সুপার এবং বাঁকুড়া থানার আইসি-কে অরূপবাবুর মন্তব্য টিভিতে দেখতে বলেছি। এর পরে ওঁর সভাধিপতি পদে থাকা উচিত নয়। মানুষকে খুন করতে দলীয় কর্মীদের প্ররোচিত করেছেন অরূপবাবু।” এ নিয়ে তাঁরা আইনি পদক্ষেপ করবেন বলেও জানান সুভাষবাবু।
সিপিএমের জেলা সম্পাদক তথা দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র বলেন, “নিজেকে আইনকানুন, প্রশাসনের ঊর্ধ্বে মনে করে জেলার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ভাবছেন অরূপবাবু। তাই সরাসরি দলের কর্মীদের এ রকম নির্দেশ দিতে পারলেন।” বাঁকুড়া কোর্টের আইনজীবী তথা জেলা কংগ্রেসের কার্যকরী সভাপতি অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “অরূপবাবু শুধু মন্যাডি গ্রামের তৃণমূল নেতাই নন, জেলা তৃণমূলেরও এক জন শীর্ষ নেতা। তাই মন্যাডি গ্রামে বলা তাঁর এই কথার প্রভাব জেলা জুড়েই পড়বে। এর পর জেলার কোথাও কোনও রাজনৈতিক খুনের ঘটনা ঘটলে প্ররোচনা দেওয়ার জন্য সরাসরি আমরা অরূপবাবুকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাব।”
গত শনিবার বিজেপি-তৃণমূল সংঘর্ষের পর থেকেই মন্যাডি গ্রামের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে। গ্রামে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। শনিবারের পর থেকেই গ্রাম কার্যত পুরুষ-শূন্য। রবিবার সেখানে ঘুরে গিয়েছে রাজ্য বিজেপি-র প্রতিনিধি দল। দলটি বাঁকুড়া মেডিক্যালে আহত কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গেও কথা বলে। ওই দল ঘুরে যাওয়ার পরে রবিবার সন্ধ্যাতেই হাসপাতালে গিয়ে সংঘর্ষে জখম তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে দেখা করেন বাঁকুড়ার তৃণমূল সাংসদ মুনমুন সেন ও অরূপবাবু। এ দিন অরূপবাবু মন্যাডি গ্রামে যান। তাঁর সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল মুনমুনেরও। কিন্তু, সাংসদ পরে সিদ্ধান্ত বদল করায় অরূপবাবুকে একাই যেতে হয় গ্রামে।
এ দিন অরূপবাবু গ্রামে ঢুকতেই তৃণমূল সমর্থক পরিবারের মহিলারা তাঁর কাছে নানা অভিযোগ জানান। বিজেপি-র কিছু লোক ঘরে ঢুকে মেয়েদের অত্যাচার করছে বলে ওই মহিলারা অভিযোগ করেন। পাশাপাশি সংঘর্ষের ঘটনার পর বাড়ির পুরুষেরা বাইরে গা ঢাকা দেওয়ায় সংসার চালাতেও সমস্যা হচ্ছে বলে সভাধিপতিকে জানান ওই মহিলারা। অরূপবাবু নির্ভয়ে গ্রামছাড়া দলীয় র্কী-সমর্থকদের ফিরে আসতে অভয় দেন। তিনি বলেন, “কেউ কিছু করবে না। ওদের বাড়ি ফিরে আসতে বল।” বিজেপি-র লোকজন বাড়িতে ঢুকে অত্যাচার চালাচ্ছে, মহিলাদের মুখ থেকে এই অভিযোগ শোনার পরেই অরূপবাবু বলেন, “শোন, তোর ঘরে যদি কোনও ব্যাটা ঢোকে কেটে দিবি! আমি বুঝে নেব।”
বিজেপি নেতা সুভাষবাবুর দাবি, “তৃণমূল আসলে আমাদের ভয় পেয়েছে। ওরা লোকসভা ভোটে জিতেছে ঠিকই। কিন্তু, ওরা ভাল করেই জানে, যে ওরা অবাধ ভোট করতে দেয়নি। আর সে কারণেই ওদের এত ভয়! মন্যাডি গ্রামেও তৃণমূল থেকে আমাদের দলে এসেছেন। তাঁদের ভয় দেখাতেই অরূপবাবু এমন শাসানি দিয়েছেন।” অরূপবাবুর পাল্টা অভিযোগ, “শুধু সুভাষবাবু নন, তাঁর ছেলেও মন্যাডি গ্রামে সন্ত্রাস চালাচ্ছে। আমরা পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছি।” যা জেনে সুভাষবাবুর আক্ষেপ, “কিছু লোক রাজনীতিকে খুবই নীচে নামিয়েছে। আমার ছেলেকেও রেয়াত করছে না। আমার ছেলের সঙ্গে বিজেপি-র দূরদূরান্তেরও সম্পর্ক নেই। ও ডাক্তারি নিয়েই ব্যস্ত। ওর বিরুদ্ধেও তৃণমূল মিথ্যা অভিযোগ করল!”
খুনের হুমকি দেওয়ার পরেও সভাধিপতির বিরুদ্ধে যে পুলিশ-প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেবে না, তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট বলেই দাবি বিরোধীদের। জেলার এক বিজেপি নেতার কথায়, “ভোটকর্মীদের মারধর করে ছাপ্পা ভোটে অভিযুক্ত সোনামুখীর বিধায়ক দীপালি সাহাকেও তো পুলিশ ধরল না। বরং তাঁকে যথেষ্ট সময় দেওয়া হল আদালতে এসে আত্মসমর্পণ করার। এই যদি অবস্থা হয়, তা হলে সভাধিপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস এই পুলিশ কী করে দেখাবে?”
বাঁকুড়া জেলা পুলিশের ডিএসপি (আইনশৃঙ্খলা) বাপ্পাদিত্য ঘোষ বলেন, “মন্যাডি গ্রামের পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ওখানে ২৪ ঘণ্টা পুলিশ মোতায়েন আছে।” আর জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (যিনি নিজেও আইনজীবী এবং সম্প্রতি দীপালি সাহার হয়ে জামিনের জন্য সওয়াল করে বিতর্কের মুখে) বলেন, “আমি জানি না, উনি ঠিক কী বলেছেন। তবে এ বিষয়ে অরূপবাবুর সঙ্গে কথা বলব।”