ব্লক অফিসের সভাকক্ষে বৃহস্পতিবার শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে তুমুল হাঙ্গামার ২৪ ঘন্টা পরেও থমথমে পাত্রসায়র এলাকা। পাত্রসায়র পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও দুই কর্মাধ্যক্ষকে মারধর এবং ব্লক অফিস ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে পাত্রসায়র ব্লক সংসদের বার্ষিক সভা ছিল। পঞ্চায়েত সমিতির নতুন ভবনের দোতলার সভায় বিডিও, সভাপতি, সহসভাপতি, কর্মাধ্যক্ষ, সদস্যেরা এবং ব্লকের সব পঞ্চায়েতের সদস্যেরা ছিলেন। সভা শেষ বতেই অশান্তির সূত্রপাত। সভাস্থলের মধ্যেই চেয়ার, টেবিল উল্টে দিয়ে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মারামারি বাধে। বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসে এলাকার তৃণমূল নেতা গোপে দত্ত সমিতির সভাপতির চেম্বারে ঢুকে ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ। মার খেয়ে বেহুঁশ হয়ে যান সভাপতি দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ সুচাঁদ দাসের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। এর পর ব্লক অফিসের সভাকক্ষ, বিডিও-র চেম্বারেও যথেচ্ছ ভাঙচুর চলে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দুই গোষ্ঠী পরস্পরের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করে। আর গভীর রাতে পাত্রসায়রের বিডিও অপূর্বকুমার বিশ্বাস পুলিশে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। সেই অভিযোগে তৃণমূলের পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য ও গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যরা ছিলেন বলে জানালেও কারও নাম উল্লেখ করেননি বিডিও। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং নিজে চড় খাওয়া সত্ত্বেও বিডিও এমন দায়সারা অভিযোগ করায় প্রশ্ন উঠেছে শাসকদলের একাংশে। তাঁদের বক্তব্য, কাউকে আড়াল করার জন্যই কি বিডিও এমন অভিযোগ পুলিশের কাছে জমা দিয়েছেন। স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের একাংশের অভিযোগ, দলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধের সুযোগ নিয়ে এক গোষ্ঠীকে তোল্লা দিচ্ছেন বিডিও। শুক্রবার তাঁর মোবাইলে একাধিক বার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। জবাব দেননি এসএমএসের।
অন্য দিকে, ওই ঘটনায় পুলিশের কাছে তিনটি অভিযোগ জমা পড়ার পরে এখনও কেউ ধরা না পড়ায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। যদিও ঘটনার পরে পুলিশের টহলদারি বাড়ানো হয়েছে এলাকা। পাশাপাশি শুক্রবার পুলিশের তরফে ওই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ চাওয়া হয়েছে বিডিও-র কাছে। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলেন, “পাত্রসায়র ব্লক অফিসে হামলার ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। কী ঘটেছিল, কারা জড়িত ছিল, তা জানার জন্য সিসিটিভি ফুটেজ নেওয়া হচ্ছে। যারা গণ্ডগোল পাকিয়েছে, তাদের সকলকে ধরা হবে।” বাঁকুড়ার জেলাশাসক বিজয়ভারতীও বলেন, “বিডিও লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। পুলিশ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।” যদিও জেলা পুলিশেরই এক কর্তার মন্তব্য, “সমস্ত ঘটনার নিজের চোখে দেখেও বিডিও-র এমন দায়সারা অভিযোগ করাটা অদ্ভুত ঠেকছে।”
গত লোকসভা ভোটের পর থেকেই পাত্রসায়র ব্লকে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মারাত্মক আকার নিয়েছে। দলের ব্লক সভাপতি স্নেহেশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একদা তাঁরই ঘনিষ্ঠ নব পাল, গোপে দত্ত, বাবলু সিংহদের বিরোধ প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। তার জেরে মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষ বাধছে দু’পক্ষের। কিন্তু, সব জেনেও দলের স্থানীয় নেতাদের রাশ টানতে জেলা নেতৃত্ব উদ্যোগী না হওয়ায় পরিস্থিতি এই আকার নিয়েছে বলে অভিযোগ পাত্রসায়রের নিচুতলার কর্মীদের। তাঁদের ক্ষোভ, “দিনের পর দিন দলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে গণ্ডগোল হচ্ছে, পার্টি অফিস, বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। এ বার তো পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, কর্মাধ্যক্ষ, পঞ্চায়েত প্রধান, উপপ্রধান, সদস্যরা আক্রান্ত হয়েছেন। তবু আমাদের জেলা নেতারা চোখ বুজে বসে রয়েছেন!”
পাত্রসায়র পঞ্চায়েত সমিতির এক কর্মাধ্যক্ষের আক্ষেপ, “দলের মধ্যে এখন নীতির নয়, ব্যক্তিগত ইগোর লড়াই শুরু হয়েছে।” বস্তুত, বৃহস্পতিবারের এত বড় ঘটনার পরেও তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব হাত গুটিয়ে বসে থাকায় দলের নিচুতলায় প্রশ্ন জেগেছে, কেন অভিযুক্ত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না? স্নেহেশবাবু এ দিন বলেছেন, “দলের জেলা সভাপতি, জেলা পরিষদের সভাধিপতিকে পুরো ঘটনা জানানো হয়েছে। যা ব্যবস্থা নেওয়ার তাঁরাই নেবেন। তবে, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আমাকে বলেছেন, দল এই ঘটনায় কী করছে তার জন্য তিনি সাত দিন দেখবেন। তার পর কোনও একটা সিদ্ধান্ত নেবেন।”
সমিতির সভাপতি দিলীপবাবুর মোবাইল এ দিন বন্ধ থাকায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। বাঁকুড়া জেলা তৃণমূল সভাপতি অরূপ খাঁ-কে ফোন করা হলে পরিচিত একজন জানিয়ে দেন, ‘উনি খুব ব্যস্ত আছেন। পরে ফোন করবেন’। এর পর বার কয়েক ফোন করা হলেও অরূপবাবু আর ধরেননি। জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী অবশ্য এ দিনও বলেছেন, “পাত্রসায়র ব্লক অফিসে কারা এমন ঘটনা ঘটাল, তা তদন্ত করে দেখে পুলিশকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।” তাঁর আরও দাবি, সভাপতি, কর্মাধ্যক্ষদের উপরে হামলা চালিয়েছে যারা, তারা সমাজবিরোধী। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি চাইলে তাঁকে পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
হামলার ঘটনায় অভিযোগের মূল তির যে দুই তৃণমূল নেতার দিকে, সেই বাবলু সিংহ ও গোপে দত্ত অবশ্য বৃহস্পতিবারই সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ দিন তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এই অবস্থায় সার কথাটা বলেছেন জেলা তৃণমূলেরই এক নেতা। তাঁর মন্তব্য, “পাত্রসায়রে যুযুধান দুই গোষ্ঠীর নেতারাই দলের উপরের দিকে বড় বড় ছাতার তলায় রয়েছেন। সকলেই তাই পিঠ বাঁচানোর জন্য যেটুকু বলা বা করা, সেটুকুই করছেন। কেউ-ই কাউকে চটাতে চাইছেন না। এর ফলে দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে। আর তা থামানোর জন্য কেউ নেই!”