নদীর দু’পাড়ে জমিয়ে রাখা হচ্ছে বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই। নিজস্ব চিত্র।
জাতীয় পরিবেশ আদালতের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। তারই মধ্যে ছাই পরিস্কারে বাধার অভিযোগকে কেন্দ্র করে সরগরম বক্রেশ্বর। যে অভিযোগকে প্রায় উড়িয়েই দিচ্ছেন বাসিন্দারা।
বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভরে যাওয়া ছাইপুকুর থেকে নির্গত ছাই চন্দ্রভাগা নদী এবং তার দুই তীরের এলাকাকে দূষিত করে ফেলেছে। সম্প্রতি পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের দায়ের করা মামলায় আদালত দ্রুত তা পরিস্কার করে এলাকাকে দূষণমুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। মামলার শুনানিতে শুক্রবারই পরিবেশ কর্মী সুভাষ দত্ত আদালতে ছবি দেখিয়ে অভিযোগ করেছিলেন, চন্দ্রভাগা নদীর ছাই তোলা শুরু হলেও সেই ছাই অন্যত্র সরানো হচ্ছে না। তা রাখা হচ্ছে নদীর পাড়েই। তাঁর আশঙ্কা, ছাই অন্যত্র না-সরালে সেগুলো আবার নদীতে মিশে দূষণ ছড়াবে।
তার পরেই বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের আইনজীবী আদালতে দাবি করেন, শাসক দলের স্থানীয় এক নেতা এবং এলাকার কিছু লোক কাজে বাধা দিচ্ছেন। ছাই তোলার কাজে সংস্থা পুলিশের সাহায্য পাচ্ছে না। নিগমের পক্ষ থেকে এই মর্মে সিউড়ি থানায় লিখিত অভিযোগও করা হয়েছে। ওই সময়ই আদালত সাফ জানিয়ে দেয়, ওই কাজ যাতে সুষ্ঠু ভাবে হয়, তা পুলিশ-প্রশাসনকেই দেখতে হবে। রাজ্যের মুখ্যসচিবকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। নিগমের এই অভিযোগকেই মানতে নারাজ এলাকাবাসী। তাঁদের সঙ্গেই গলা মিলিয়েছে শাসক দল তৃণমূলও। তাঁদের পাল্টা দাবি, নদী থেকে ছাই ঠিকমতো সরানো হচ্ছিল না। এই অভিযোগ তুলে প্রথম দিকে কয়েক ঘণ্টার জন্য স্থানীয় বাসিন্দারা বাধা দিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় সমস্যা মিটতেই নদী পরিস্কারের ক্ষেত্রে আর কোনও বাধা দেওয়া হয়নি।
প্রসঙ্গত, বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাইপুকুর বহু দিন আগেই ভরে গিয়েছে। সেখান থেকে ছাই উড়ে দূষণ ছড়াচ্ছে। যার জেরে এলাকার কমবেশি ১০০টি গ্রামে কৃষিকাজ, মাছ চাষ ও গবাদি পশু পালনের ক্ষতি হচ্ছে বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। প্রভাব পড়েছে বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যেও। শুধু তা-ই নয়, ছাই জমে জমে চন্দ্রভাগা নদীও বিপন্ন। ছাইয়ের স্তূপে নদীটি কার্যত মজে যেতে বসেছে। গত অক্টোবরে সুভাষবাবু জাতীয় পরিবেশ আদালতে এ নিয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার প্রেক্ষিতেই গত ২৭ নভেম্বর জাতীয় পরিবেশ আদালতের পূর্বাঞ্চলীয় শাখা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমকে নির্দেশ দেয়, ১৫ দিনের মধ্যে ওই নদী থেকে সব ছাই তুলে ফেলতে হবে। তার পর থেকেই বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। এক দিকে, ছাইপুকুর থেকে ছাইমিশ্রিত জল যাতে নদীতে না মেশে, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি একাধিক যন্ত্র লাগিয়ে চন্দ্রভাগা নদী থেকে ছাই-মুক্তির কাজও শুরু হয়েছে।
কিন্তু, গত ৪ ডিসেম্বর সেই কাজই হঠাৎ থমকে যায়। স্থানীয় কিছু মানুষ ওই কাজে বাধা দিয়ে অভিযোগ করেন, যন্ত্র লাগালেও নদী গর্ভ থেকে ছাই পরিস্কারের কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না। চন্দ্রভাগা নদী লাগোয়া মল্লিকপুর, রাইপুর, পলসাড়া, অমিত্রপুর, গজালপুর থেকে আসা সুবল দত্ত, রিন্টু সেন, বাবু আনসারিদের দাবি ছিল, আদালতের নির্দেশে কাজ শুরু হয়েছে ঠিকই। কিন্তু, ছাই তুলে নদী গর্ভেই জমিয়ে রাখা হচ্ছে। বৃষ্টি হলেই যে ছাই আবার নদীতে মিশে দূষণ ছড়াবে। সুবলবাবুদের বক্তব্য, “এতে আর লাভ কী? কাজ যখন হচ্ছে, তখন ঠিক করে করতে হবে। এমনিতেই ছাই জমে নদী মজে গিয়েছে। ছাই মিশ্রিত মাটি নদী গর্ভে রাখলে সে তো আবার জলে মিশবে!” এ নিয়ে কিছু ক্ষণ সমস্যা হলেও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার মহীতোষ মাজির সঙ্গে একপ্রস্থ আলোচনার পরেই বাসিন্দারা ফিরে যান। আগের মতোই কাজ শুরু হয়। তার পর থেকে কাজে আর তেমন বাধা আসেনি বলেই দাবি এলাকাবাসীর। খোদ মহীতোষবাবুও সে কথা মেনে নিয়েছে।
তা হলে নিগমের পক্ষ থেকে আদালতে কাজে বাধার অভিযোগ তোলা হল কেন? মহীতোষবাবুর বক্তব্য, “আমরা কারও নাম করিনি। সে দিনের ঘটনায় সিউড়ি থানায় একটা অভিযোগ দায়ের হয়েছিল।” এ দিকে, স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, আদতে আদালতের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে নদী ছাইমুক্ত করার কাজ যথযথ ভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য আরও কিছুটা সময় পেতেই বিষয়টিকে বড় করে দেখানো হচ্ছে। নিগমের আইনজীবীর অভিযোগ মানেননি তৃণমূল নেতারাও। জেলার সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী বলেন, “আমরা এলাকার মানুষকে বুঝিয়েছি, তাঁদের ভালর জন্যই কাজ হচ্ছে। এলাকাবাসীও চান, কাজ যখন হচ্ছে, তা যেন ভাল ভাবে হয়। এখন কেউ কোনও বাধা সৃষ্টি করছেন, এটা ঠিক কথা নয়। ছিক ভাবে দূষণ-মুক্তির কাজ চলছে।”
অন্য দিকে, মহীতোষবাবুও জানান, নদী থেকে ছাই পরিস্কারের কাজ পুরোদমে চলছে। তবে, তাঁর দাবি, “ছাই নদীগর্ভে ফেলে রাখা হচ্ছে বলে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। আসলে ছাইযুক্ত পলিমাটির জন্য ওখানে ট্রাক্টর নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। মাটি একটু শক্ত হলেই নদীর দুই পাড় থেকে ছাই তুলে ফেলা হবে।”
নিগমের আইনজীবীর অভিযোগের পরেই চন্দ্রভাগা নদী থেকে ছাই তোলার কাজে জেলার পুলিশ-প্রশাসন সব ধরনের সাহায্য করার নির্দেশ দিয়েছে পরিবেশ আদালত। এ দিন যোগাযোগ করা হলে জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলেন, “নিগম ওখানে ছাই-মুক্তির কাজ শুরু করেছে। আমাদের যদি কোনও সাহায্য লাগে, আমরা তা করতে প্রস্তুত আছি।” একই আশ্বাস দিয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়াও।
আগামী ২২ জানুয়ারি জাতীয় পরিবেশ আদালতে চন্দ্রভাগা নদী থেকে ছাই তোলার কাজ কী ভাবে এগোচ্ছে, তার রিপোর্ট জমা পড়বে।