চলছে আম বিক্রি। —নিজস্ব চিত্র
পিৎজা, বার্গারে বাঙালি মজলেও আম নিয়ে মাতামাতি একটুকুও কমেনি। তাই আম পরিবারের তারকা ল্যাংড়া. আম্রপালি, হিমসাগর, মল্লিকাকে নিয়ে মজার মজার ছড়ার ব্যানার সাজিয়ে আম উৎসব শুরু হয়েছে পুরুলিয়ায়। গুচ্ছের কাজ নিয়ে অফিস-আদালতে আসা মানুষজন তাই কিছুতেই আম উৎসবের ডাক এড়িয়ে যেতে পারছেন না। সটান ঢুকে পড়ছেন জেলা গ্রামোন্নয়ন সংস্থার ভবন চত্বরে।
রংবেরঙের ছাতার নীচে থরে থরে সাজানো নানা প্রজাতির আম। কোনও টেবিলে গড়াগড়ি খাচ্ছে আম্রপালি, কোথাও মল্লিকা, কোথাও আবার দশেরা, বেলখাস বা বুনো আম। তাদের দেখেই চিত্ত বিগলিত রসিকজনের। অগত্যা আম কিনতে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়া।
বিভিন্ন প্রজাতির আম নিয়ে বৃহস্পতিবার থেকে পুরুলিয়ায় শুরু হয়েছে দু’দিনের আম উৎসব। স্বাদের জন্য আমের সঙ্গে অনেকে অমৃতেরও তুলনা টানেন বলে এই উৎসবের পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে অমৃত উৎসব। যদিও সবার মুখে তা আম উৎসব বলে ঘুরছে। আয়োজন করেছে জেলা গ্রামোন্নয়ন সংস্থা।
জেলার বিভিন্ন এলাকায় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর বাগানে ফলা আম নিয়েই শুরু হয়েছে এই উৎসবের। বাঘমুণ্ডির চিরুগোড়া গ্রাম থেকে আম্রপালি নিয়ে এসেছেন কিরীটি মাহাতো। অযোধ্যা পাহাড়ের নীচে সেই চিরুগোড়া গ্রাম। এক রাতে এই গ্রামে হানা দিয়ে মাওবাদীরা তিনজনকে খুন করে। সন্ত্রাস পিছনে ফেলে এই গ্রামের বীণাপানি মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী আম্রপালি আমের চাষ করেছে। ওই স্বনির্ভর গোষ্ঠীর হয়ে মেলায় আম বিক্রি করছিলেন কিরীটিবাবু। তিনি বলেন, “আম্রপালি বিক্রি করছি কেজি প্রতি ৪০ টাকা ও মল্লিকা কেজি প্রতি ৩৫ টাকায়। তা ছাড়া একটু ছোট আকারের আমগুলোর দাম কেজিতে পাঁচ টাকা করে কম নিচ্ছি।” কেমন বিক্রি হচ্ছে? তিনি জানান, প্রথম দিনে বিক্রি ভালই হয়েছে।
সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের (সিএডিসি) অযোধ্যা পাহাড় প্রকল্পের বাগান থেকেও নানা প্রজাতির আম এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ষড়ঙ্গী। তিনি জানান, উৎসব শুরু হওয়ার কিছু পরেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তবে তাতে বিক্রি কমেনি। এ দিনের বেচাকেনায় তিনি সন্তুষ্ট। কাশীপুরের আমশোলা থেকে কাঁচা আম এনেছিলেন জানিক বাউরি। তাঁর কথায়, “এখন তো পাকা আমের মরসুম। কিন্তু কাঁচা আমের বিক্রিও ভাল।” বিভিন্ন প্রজাতির আম ছাড়াও কাঁচা আমের আচার, আম-গুড় ও আমের কাসুন্দিও বিক্রি হচ্ছে। এগুলি তৈরি করেছে বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যারা। এরকমই একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য কবিতা মাহাতো বললেন, “আম-গুড়ের চাহিদা এখানে ভালই।”
আম নিয়ে কেন এ ধরনের মেলার আয়োজন? মেলার উদ্যোক্তা জেলা গ্রামোন্নয়ন সংস্থার উপ-অধিকর্তা সুশান্তরঞ্জন ভক্ত বলেন, “গত বছর আমরা খুব ছোট করে আম নিয়ে একটা মেলা করেছিলাম। তা সফল হওয়ায় এ বারে একটু বড় আকারে করে করেছি।” তাঁর কথায়, এই জেলায় চাষ বলতে লোকে মনে করে ধান আর সব্জি চাষ। কিন্তু সেই সঙ্গে ফলের চাষ যে বিকল্প চাষ হতে পারে এই বিশ্বাসটা চাষিদের মধ্যে থাকা প্রয়োজন। তা ছাড়া পুরুলিয়ার শুষ্ক মাটিতে বিভিন্ন প্রজাতির আমের গন্ধ যে এত ভালো হতে পারে, জেলার মানুষের কাছে এই তথ্য পৌঁছনো প্রয়োজন। সেই সঙ্গে আম উৎপাদনকারী স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে বাজার পাইয়ে দেওয়াও লক্ষ্য।
তিনি জানান, গত সাত-আট বছর ধরে পুরুলিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ফল চাষ নিয়ে বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করেছে। তাদের সহায়তায় পুরুলিয়ার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর বাগানে যে আম ফলেছে তার সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘটানোও এই মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য। তাঁদের উদ্দেশে যে অনেকটা সফল প্রথম দিনেই তা বোঝা গিয়েছে। যেমন পুরুলিয়া শহরের বাসিন্দা জয়শ্রী মাহাতো আম কিনে বেরোনোর পথে বললেন, “আমাদের জেলায় এত ভালো আম হয় জানতাম না। মেলা থেকে অনেক আম কিনলাম।”
আর এক ক্রেতা হেমা বাউরির প্রতিক্রিয়া, “অনেক রকম আমের সম্ভার রয়েছে এখানে। ভালো উদ্যোগ।” সুশান্তরঞ্জনবাবু জানান, আগামী দিনে পুরুলিয়া জেলার অন্যত্রও আম উৎসব করার ভাবনা তাঁদের রয়েছে। তাঁদের স্বপ্ন, ভবিষ্যতে প্যাকেট বন্দি করে পুরুলিয়ার আম রাজ্যের বাজারে ছাড়ার। ছৌ, ঝুমুরের সঙ্গে পুরুলিয়ার নতুন গর্ব হতে চলেছে আম।