১৪ বছরেও পাল্টায়নি চিত্র। গরু-ছাগলের বিচরণ ভূমি অধিগৃহীত জমি। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পরে এলাকায় এসে ‘শিল্প নিকেতন’ গড়ার ডাক দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিলান্যাস করেছিলেন আইটি হাবের। কিন্তু সে জমির একাংশে কাজ শুরু হলেও, শিল্পের জন্য অধিগৃহীত জমির ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনও ধোঁয়াশায় বোলপুরের শিবপুর মৌজা। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ, বাজার দর অনুযায়ী ন্যায্য দামের কোনওটাই না মেলায় কার্যত অন্ধকারে শিল্পতালুকের জন্য জমিদাতা কৃষিজীবীরা।
বিগত বাম জমানায় শিল্পের জন্য অধিগৃহীত শিবপুর মৌজায় কৃষিজমিতে কী হবে সে নিয়ে সেই ২০০১ সাল থেকেই ধন্দে এলাকার কৃষিজীবী মানুষ। অধিগ্রহণ পর্বে যে শ’খানেক চাষি, জমি দিয়েও ক্ষতিপূরণের চেক নেননি, ২০০৮ সালে তাঁরা তৃণমূলের নেতৃত্বে ‘শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতন কৃষিজমি বাঁচাও কমিটি’ গড়ে তুলেছিলেন। বাম আমলে অধিগ্রহণের প্রায় এক দশক পরে, তৎকালীন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় এলাকায় এসে কৃষিজমি রক্ষা কমিটির আন্দোলনকে গতি দিতে বলেছিলেন, ‘‘হয় শিল্প, নয় উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ সহ জমি ফেরত’ দিতে হবে।” ক্ষমতায় আসার প্রায় তিন বছর হতে চলেছে। ওই কৃষিজমির ওপর নির্ভরশীল প্রায় ১২০০ জমি মালিক, বর্গাদার, খেত মজুরের প্রশ্ন আর কবে হবে শিল্প? আইটি হাবের নামে যে নির্মাণ শুরু হয়েছে, তারই বা ভবিষ্যৎ কী?
শিল্পস্থাপনের জন্য শিবপুর মৌজায় যে ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়, তার মধ্যে মোট ২০৬ একরে শিল্প করা হবে বলে জানিয়েছিল বাম সরকার। নতুন সরকার ওই জমির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ শিল্প উন্নয়ন নিগমকে ৫০ একর, ‘বিশ্ববাজার’ তৈরি করানোর জন্য ৫০ একর, রাজ্য পর্যটন দফতরকে ১০ একর, পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরকে ৫ একর, আইটি হাবের জন্য ৫ একর এবং একটি বেসরকারি হার্ডঅয়্যার সংস্থাকে ১৪ একর জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিছু কংক্রিটের কাজও শুরু হয় সরকার ঘোষিত আইটি পার্কের নামে। আইটি হাবের জন্য রাজ্য সরকারের সংস্থা ওয়েবেল ইতিমধ্যে ওই নিচু জমিতে শিল্প উপযোগী করে তুলতে তাঁদের সিভিল কাজ শুরু করেছে। শাসক দলের বীরভূম জেলা সভাপতি তথা ডবলিউবিআইআরডিসির চেয়ারম্যান অনুব্রত মণ্ডলের দাবি, “ওখানে জোর কদমে আইটি পার্কের কাজকর্ম চলছে। খুব দ্রুত কাজ শেষ হবে।”
এলাকায় শিল্প হলে, কর্মসংস্থান বাড়বে। বদলে যাবে তাঁদের আর্থ সামাজিক অবস্থা। এই স্বপ্ন দেখে যাঁরা জমি দিয়েছিলেন, কি বলছেন তাঁরা? বোলপুর শ্রীনিকেতন পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি তথা সিপিএমের বোলপুর জোনাল কমিটি সদস্য মহম্মদ একিন খান বলেন, “রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে প্রকল্পের বিষয়টিকে বিষিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা দলীয় ভাবে স্থানীয় মানুষদের দাবি সকলকে জানিয়েছিলাম। এখনও বলছি, আমরা চাই ওখানে শিল্প হোক, স্থানীয়দের উপযুক্ত কর্মসংস্থান হোক। যাঁরা জমি দিয়েছেন, তাঁদের কথা ভেবে শিবপুর মৌজার আর্থ সামাজিক অবস্থার অবশ্যই পরিবর্তন প্রয়োজন রয়েছে।”
‘শ্রীনিকেতন শান্তিনিকেতন কৃষিজমি বাঁচাও কমিটি’-র সম্পাদক মোজাম্মেল হক বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীর এখানে ‘শিল্প নিকেতন’ হওয়ার কথা দিয়েছিলেন। সে কথা এখনও রাখেন নি। ওখানে শিল্পই গড়ে উঠুক।” স্থানীয় জমিদাতা সুজিত গড়াই, মধুসূদন গড়াই, মুজিবর রহমান বলেন, “আইটি পার্কের নামে যে নির্মাণটি হচ্ছে, তার কোনও ভবিষৎ জানা নেই আমাদের। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও কর্মসংস্থান দিতে হবে। শুধু ওই আইটি হাব দিয়ে কতজনের কর্মসংস্থান হবে জানি না। পুরো মাঠই তো ধূ ধূ প্রান্তর।”
বোলপুর এলাকার জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী এবং পার্থবাবুর ঘোষিত আইটি হাব নিয়ে সদুত্তর নেই এখন উন্নয়ন পর্ষদের কাছেও। পর্ষদের নির্বাহী আধিকারিক পুলক সরকার এ দিন বলেন, “আমাদের দফতর ইমপ্লিমেন্টিং এজেন্সি নয়। তবে ওই এলাকায় আইটি হাব হচ্ছে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না। সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, সবিস্তারে তাঁরা বলতে পারবেন।”
প্রশাসন সূত্রে খবর, রাজ্যে বোলপুর সহ আটটি জায়গায় ওয়েবেল আইটি পার্কের কাজ করছে। ওয়েবেলের বোলপুর আইটি পার্কের প্রোজেক্ট ম্যানেজার শুভদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “মোট জমির ৪ দশমিক ৯৪ একর এলাকায় আমরা আইটি পার্ক গড়ে তুলছি। ২০১৩ ডিসেম্বর চালু করা সিভিল কাজ জোর কদমে চলছে।” তাঁর দাবি, ২০১৫ মার্চের মধ্যে গোটা আইটি পার্কের কাজ শেষ হবে। স্থানীয়দের আইটি সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ-সহ হাজার তিনেক যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থান হবে।
শুভদীপবাবুর কথায় ভরসা পাচ্ছেন না এলাকার মানুষ। কেন না, আন্দোলনের সময়, অধিগৃহীত জমির সিমেন্টের সীমানা খুঁটি উপড়ে তাঁদের একাংশ ধান চাষও শুরু করেছিলেন। জমির ন্যায্য দাবিতে তাঁদের বেড়া ভাঙা ঠেকাতে পুলিশকেও মাঠে নামতে হয়েছিল। তবু শিল্প হয়নি শিল্পের জন্য অধিগৃহীত শিবপুর মৌজায় কৃষিজমিতে! রয়ে গিয়েছে বেবাক ফাঁকা মাঠ। হয়নি মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত ‘শিল্প নিকেতন’-ও!