বছরভর এ ভাবেই পার হতে হয় সিউড়ি সিরাজবাগান এলাকার বাসিন্দাদের। —নিজস্ব চিত্র।
বছর চারেক আগে গ্রামে ঢোকার একমাত্র রাস্তায় থাকা কাঁদরের উপর পাকা সেতু তৈরি হতে দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন সিউড়ি ১ ব্লকের সিরাজবাগান আদিবাসী গ্রামের বাসিন্দারা। কিন্তু সেই খুশি স্থায়ী হয়েছিল মাত্র দিন কয়েক। পঞ্চায়েত সূত্রে খবর, তৎকালীন ওই সংসদের নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্য ও উপভোক্তা কমিটির মধ্যে টাকার ‘ভাগ বাটোয়ারা’ নিয়ে বিবাদের জেরে কাজ থমকে গিয়েছে। তারপর থেকে বিধানসভা, পঞ্চায়েত ও লোকসভা নির্বাচন পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেতু তৈরির কাজ আজও শেষ হয়নি। একই রকম দুর্ভোগের মধ্যে থাকতে থাকতে ক্লান্ত ভুরকুনা পঞ্চায়েতের ওই আদিবাসী গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁদের প্রশ্ন এ ভাবে আর কতকাল কাটাব আমরা?
ভুরকুনা পঞ্চায়েত ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই পঞ্চায়েতের লালমোহনপুর সংসদের মধ্যে থাকা সিরাজবাগান গ্রামে খুব বেশি পরিবার বাস করে না। সাকুল্য ৩৫টি পরিবারের বাস। গ্রামের একদিকে রয়েছে বক্রেশ্বর নদ, অপর দিকে রয়েছে সিরাজবাগান কাঁদর। বর্ষাকাল তো বটেই অন্য সময়ও গ্রামের বাইরে আসতে হলে হাঁটু জল ভাঙতে হয় বাসিন্দাদের। শুধু জল ভেঙে যাতায়াতের কষ্টই নয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, গ্রামের রাস্তাঘাটের অবস্থাও খারাপ। কিছুদিন আগে পর্যন্ত পানীয় জলের জন্য কোনও নলকূপ ছিল না। আজও বিদ্যুৎ নেই।
স্থানীয় পঞ্চায়েত সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই গ্রামের দীর্ঘ দিনের দাবি মেনে ১০০ দিন কাজ প্রকল্পের (৪০ শতাংশ কংক্রিটের কাজ করার) ২১ লক্ষ ৩৬ হাজার ১১২ টাকা ব্যায়ে ২০১০ সালের মাঝামাঝি সেতুর কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন পঞ্চায়েত সদস্য ও কাজের জন্য নির্ধারিত উপভোক্তা কমিটির মধ্যে কাজের গুণমান নিয়ে বাদানুবাদ হওয়ার পরই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই বলছেন, “বাদানুবাদ শুরু হয়েছিল বখরা নিয়ে গণ্ডগোলের জেরে। তারপর প্রশাসনিক ভাবে দু-একবার সব পক্ষকে বসিয়ে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সমাধান সূত্র মেলেনি।” বাসিন্দাদের ক্ষোভ, আসলে সে ভাবে গ্রামের সমস্যা মেটাতে তেমন আগ্রহ দেখায়নি পঞ্চায়েত। সেটা ডান-বাম যেই ক্ষমতায় থাকুক না কেন। স্থানীয় বাসিন্দা হাবল হেমব্রম, বলহরি টুডু, বুড়ি হেমব্রম, মুনি কিস্কু বা সোমাই হেমব্রমরা বলছেন, “যখন কাজ শুরু হল ভেবেছিলাম আমাদের অবস্থা বদলে যাবে। সেটা আর পূরণ হল না। এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য, পঞ্চায়েত এবং ব্লকে বহুবার জানিয়েছি। কিন্তু কাজ আর এগোয়নি। ফসলের মাঠ যেতেই হোক বা রুজিরুটির টানে গ্রামের বাইরে যাওয়া, এই কাঁদর পার হওয়া ছা়ড়া কোনও উপায় নেই।” শুধু কী পঞ্চায়েত? ব্লক অফিস, হাসপাতাল বা নানান কাজে সদর শহর সিউড়িতে যেতে এই পথই ভরসা।
গত কয়েক মাস আগে ক্ষমতাসীন বোর্ডের বদল হয়েছে। তবে সিরাজবাগানের সেতু নিয়ে বর্তমান বোর্ডও ইতিবাচক ভূমিকা নেয়নি অভিযোগ বাসিন্দাদের। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ১১ আসন বিশিষ্ট পঞ্চায়েতে ৫টি করে আসন পেয়েছিল তৃণমূল, সিপিএম। আর ১টি আসন পেয়েছে নির্দল (তৃণমূল সমর্থিত)। তবে পঞ্চায়েত প্রধানের পদটি তফসিলি জাতি মহিলা সংরক্ষিত হওয়ায় সিপিএমের টিকিটে জেতা চাঁদমনি বেসরা বর্তমানে প্রধান পদে রয়েছেন। ওই গ্রামের বাসিন্দারা যে সত্যিই সমস্যায় রয়েছেন, সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন পঞ্চায়েত প্রধান। তিনি বলেন, “সত্যিই ওঁদের খুব কষ্ট। অবশ্যই এটা দূর করা পঞ্চায়েতের দায়িত্ব। সকলকে বসিয়ে একবার বৈঠক করে সমস্যা মেটাবার চেষ্টা করব। না পারলে বিডিওকে জানাব।” যদিও বাসিন্দারা বলছেন, কাজের জন্য নির্ধারিত খরচ বেড়ে এখন দ্বিগুণ হয়েছে। যত দেরি হবে সমস্যা তত জটিল হবে।
সিউড়ি ১ ব্লকের বিডিও মুনমুন ঘোষ বলেন, “চার বছর আগের বিষয় আমার জানা নেই। তবে এমনটা হয়ে থাকলে নিশ্চই আমি খোঁজ নেব। তবে এত অসুবিধার মধ্যে ওই গ্রামের বাসিন্দাদের জন্য একটা ভাল খবর রয়েছে। সেটা হল শীঘ্রই ওই গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে।” বুধবার এবং বৃহস্পতিবার দু’দিন বিদ্যুতের খুঁটি পোঁতা হয়েছে। বাসিন্দারা তাও আশার আলো দেখতে পারছেন না। তাঁরা বললেন, “সেতুর কাজ যখন শুরু হল তখন ভেবেছিলাম কিছুটা দুর্ভোগ কমবে। কিন্তু সেই ভোগান্তি দূর হল না। তাই আগে আলো জ্বলুক। তবেই বিশ্বাস করব।”