সর্বক্ষণের জন্য লোক নেই। তাই বন্ধই থাকে ধাত্রীদেবতা। ফিরে যাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি
স্মৃতির রক্ষার চেয়েও ভারি হয়ে উঠছে কমিটি!
তারাশঙ্করের স্মৃতি রক্ষার্থে একের পর এক কমিটি গঠনের বহর দেখে বীতশ্রদ্ধ লাভপুরের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। বিরক্ত সাহিত্যিকের পরিবারের সদস্যরাও।
‘কবি’-র কথাশিল্পীর স্মৃতি রক্ষা নিয়ে টানাপোড়েন অবশ্য নতুন নয়। কমিটি নিয়ে কোন্দল দীর্ঘ দিনের। আটের দশকে তারাশঙ্করের কাছারি বাড়ি তথা সাধনক্ষেত্র ধাত্রীদেবতা বাড়িতে তাঁর জন্মদিন পালনের উদ্যোগ নেয় কোটাসুরের দিদিভাই পত্রিকা গোষ্ঠী। পরবর্তীকালে মহাদেব দত্ত-সহ বেশ কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মীর উদ্যোগে গড়ে ওঠে তারাশঙ্কর সংসদ। তাঁরাই ধাত্রীদেবতায় জন্মদিন পালনের আয়োজন করে। কিন্তু ওই সংস্থার উপর সরাসরি কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকায়, তাতে তদানীন্তন শাসকদল সিপিএম তথা বামফ্রন্ট সামিল হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। শোনা যায়, তারাশঙ্করের জন্মদিন পালন করে পাছে অন্যরা একতরফা প্রচার পেয়ে যাবে সেটা নাকি মেনে নিতে পারেননি তৎকালীন শাসকদলের জেলা নেতারা। ফলে, স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির পরিচালনায় তাঁরা সমান্তরালভাবে সন্দীপন পাঠশালায় জন্মদিন পালনের আয়োজন করে।
১৯৯৭ সালে অবশ্য তারাশঙ্করের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে দু’পক্ষ বৈঠকে বসে। গড়ে ওঠে তারাশঙ্কর জন্মশতবর্ষ কমিটি। ওইসময় তারাশঙ্কর চর্চার জন্য তারামা ডাঙ্গায় কমিটিকে ৪ একর জায়গা দান করেন সাহিত্যিকের পরিবার। একই সময়ে ধাত্রীদেবতা বাড়িটিকেও তুলে দেওয়া হয় পঞ্চায়েত সমিতির হাতে। কেন্দ্রীয় পর্যটন দফতর ধাত্রী দেবতার উন্নয়নের জন্য প্রায় ১২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। কিন্তু সেই টাকা সংস্কৃতিপ্রেমীদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে লাগানো হয় তারামা ডাঙ্গায় নির্মীয়মান তারাশঙ্কর শতবার্ষিকী ভবনের কাজে।
কার্যত অবহেলায় পড়ে থাকতে থাকতে ধাত্রীদেবতায় বিনষ্ট হয়ে যায় তারাশঙ্করের তৈরি কাটুম-কুটুম, নানা জিনিসপত্র। সাংস্কৃতিক কর্মীদের দাবি, তারামাডাঙ্গায় নির্মিত বিশাল বাড়িটি কার্যত শাসকদলের কার্যালয়ের রূপ নেয় সেই সময়। আর সেই কারণেই, এলাকার সাংস্কৃতিক কর্মীরা মুখ ঘুরিয়ে নেন। তাঁরা ধাত্রীদেবতায় ফেরেন ২০০৪ সালে। সে সময়ই গড়ে ওঠে তারাশঙ্কর অনুশীলন সমিতি।
ওই সংস্থা ধাত্রীদেবতায় ১৪ সেপ্টেম্বর তারাশঙ্করের মৃত্যুদিন পালনের আয়োজন করে। কিন্তু শাসকদলের বাধায়, পঞ্চায়েত সমিতির অনুমতি স্বত্ত্বেও পরের বার আর ধাত্রীদেবতার চাবি পাননি উদ্যোক্তারা। বাধ্য হয়ে তাঁরা স্থানীয় ঠাকুরবাড়িতে ওই অনুষ্ঠান করেন। কিন্তু রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে ওই সংস্থাও স্থায়ী হয়নি। তারপর থেকেই বীরভূম সংস্কৃতিবাহিনী মাঠে নামে। স্বতন্ত্রভাবে তাঁরা লোক উৎসব হিসাবে তারাশঙ্করের প্রয়াণ দিবস পালন করে। কিন্তু এখানেই কমিটি নিয়ে কোন্দলের শেষ নয়!
রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর, বর্তমান শাসকদলের ইচ্ছানুসারে তারাশঙ্কর ও ধাত্রীদেবতা উন্নয়ন কমিটি নামে গঠিত হয় ফের একটি কমিটি। ওই কমিটির চাপে সিপিএম নেতাদের হাত থেকে ধাত্রীদেবতা এবং তারাশঙ্কর ভবনের চাবি হাতে নেয় প্রশাসন। পর্যটন দফতরের বরাদ্দ টাকায় ও জেলা প্রশাসনের অর্থানুকুল্যে ধাত্রীদেবতায় কিছু নির্মাণ কাজ ও বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর তত্ত্ববধানে তারাশঙ্করের জীবনচিত্র সংগ্রহ ছাড়া তেমন কিছু উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি ওই কমিটিও। সংস্কৃতি বাহিনীর সম্পাদক উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় বলেন, “দেখভালের অভাবে তালা বন্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে ধাত্রীদেবতা। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে লেখকের স্মৃতি।” তারাশঙ্কর ভবন ও ধাত্রীদেবতা উন্নয়ন কমিটির সদস্য সুব্রত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “প্রশাসনের উচিত ধাত্রীদেবতায় সর্বক্ষণের লোক নিয়োগ করা। নাহলে তালাবন্ধ দেখে পর্যটকরা ফিরে যাচ্ছেন।”
কী বলছে প্রশাসন, কবে সর্বক্ষণের জন্য খুলবে ধাত্রীদেবতা?
লাভপুরের বিডিও জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, “কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
কমিটি পরিবর্তনের এহেন ধারাবাহিকতায় তারাশঙ্কর ভবনের অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। কারণ একসময়, শুধুমাত্র তারাশঙ্কর চর্চার শর্তে তারাশঙ্কর শতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির নামে তারামা ডাঙায় ৪ বিঘে জমি দান করেন সাহিত্যিকের পরিবারের সদস্যরা। ওই জমির উপরেই পঞ্চায়েত সমিতির তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় তারাশঙ্কর ভবন। কিন্তু অজানা কারণে ওই কমিটির অবলুপ্তি ঘটিয়ে তারাশঙ্কর স্মৃতি সমিতি নামে ফের একটি কমিটি তৈরি হয়। এই নাম পরিবর্তনের পর, জমির মালিকানা ফেরতের জন্য আদালতে মামলা জমি দাতাদের অন্যতম, তারাশঙ্করের ভ্রাতষ্পুত্র চিত্র পরিচালক পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “তারাশঙ্কর চর্চার শর্তে আমরা জমি দিয়েছিলাম। কিন্তু তা অমান্য করে উদ্যোক্তারা তারাশঙ্কর ভবনকে রাজনৈতিক আখড়ায় পরিণত করেছিলেন। তাছাড়া ইতিপূর্বে ধাত্রীদেবতার দান করা জমির একাংশ কমিটির এক কর্তা নিজের নামে রের্কডভুক্ত করে নিয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই রাতারাতি কমিটির নাম পরিবর্তন মেনে নিতে পারিনি। তবে জায়গার মালিকানা ফেরত পেলে, আমরা চাইব কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকার ভবন অধিগ্রহণ করে স্থানীয় কোনও সাংস্কৃতিক সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে তারাশঙ্কর চর্চার উদ্যোগ নিক।”
দু’টি কমিতিতেই যুগ্ম-সম্পাদক হিসাবে নাম রয়েছে তৎকালীন সিপিএমের জোনাল কমিটির সদস্য সুপ্রভাত বটব্যালের। এলাকার অভিযোগ, সুপ্রভাতবাবুদের রাজনৈতিক আগ্রাসনের জন্যই এমনটা ঘটেছে। একই সুর শোনা গিয়েছে পলাশবাবুর গলাতেও।
সুপ্রভাতবাবু বলেন, “আমি ওখান থেকে সরে এসেছি। তাছাড়া বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন। তাই কিছু মন্তব্য করব না।” কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মহাদেব দত্ত অবশ্য বলছেন, “ওই ভবন থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হত, একথা সত্য। কিন্তু একেবারে যে তারাশঙ্কর চর্চা হয়নি, তেমন তাও নয়। শতবর্ষ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর সংখ্যা গরিষ্ঠমতে কমিটির নাম পরিবর্তন করা হয়। তা স্বত্ত্বেও পলাশবাবু কোন উদ্দ্যেশে জমি ফেরত চাইছেন বুঝতে পারছি না!”