সিউড়ি আদালত চত্বরে কালেক্টরেট ভবন। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।
ইতিহাসের শহর সিউড়ি।
অথচ এমন ঐশ্বর্য্যেভরা সেই ইতিহাসই ভুলতে বসেছে শহরের বর্তমান প্রজন্ম। প্রাচীন এই শহরের আরও বড় আক্ষেপ, প্রশাসনিক গাফিলতিতে ইতিমধ্যেই বহু ইতিহাস ধ্বংস হয়েছে। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কার্যত চ্যালেঞ্জের মুখে ব্রিটিশ-সিউড়ির স্থাপত্যমাখা সমৃদ্ধশালী ইতিহাস।
অথচ সিউড়িতে জেলা প্রশাসনিক ভবন সংলগ্ন এলাকায় এসে পৌঁছলেই নজরে পড়বে ব্রিটিশদের শাসন কালের চিহ্ন। আগের দাপট হারালেও ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশদের শাসন কালে তৈরি কালেক্টরেট ভবনটি এখনও ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে এই শহরের বুকে। তার ঠিক পাশে রয়েছে ওই ভবনেরই বছর তিনেক পরে নির্মিত জজকোর্ট ভবনটিও। শুধু ওই দু’টি ভবনই নয়, বর্তমানের তথ্য ও সংস্কৃতি ভবন, জেলাশাসকের বাংলো, সংশোধানাগার, জেলা স্কুল, জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের অফিস, চার্চ, সাহেবপাড়া সবেতেই শতাব্দী প্রাচীন ব্রিচিশ আমলের ছাপ। তবে, এই শহর গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে রাজনগর ও হেতমপুরের রাজাদের অবদানও কম নয়। কিন্তু প্রাচীন নথি ছাড়া সেই ইতিহাস আজ আর টিকে নেই। ১৭৮৬ থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত টানা দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে সিউড়ি জেলা সদর হিসেবেই ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে ছিল। সেই সুবাদেই এ শহরে ইংরেজ আমলের বহু স্মৃতিই রয়ে গিয়েছে। তবে, উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে তার ঔজ্জ্বল্য আজ অনেকটাই ফিকে। অথচ ছ’য়ের দশকের গোড়ার দিকেও সিউড়িতে মিশনারিরা থাকতেন। ছিল ঘোড়ায় টানা গাড়িও। শহরের বুকে সেই ঘোড়ায় টানা গাড়ি চলতে দেখেছেন, এমন অনেক প্রবীণ মানুষ আজও বেঁচে রয়েছেন।
এমনই এক প্রবীণ সিউড়ি লালকুঠি পাড়ার বাসিন্দা সুকুমার সিংহ। দীর্ঘ দিন ছিলেন সিউড়ি কালেক্টরেটের অফিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট। ঐতিহাসিক একটি বিল্ডিংয়ে কাজের সুবাদে এবং তত্কালীন বহু দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংস্পর্শে এসে সিউড়ির ইতিহাস গুলে খেয়েছেন। তিনি বলছেন, “এই শহর ১৫০ বছরেরও বেশি ইংরেজ শাসন দেখেছে। এই শহর সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে স্বদেশি আন্দোলন, সবই চাক্ষুস করেছে। মহাত্মা গাঁধী, চিত্তরঞ্জন দাশ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কার পা এখানে পড়েনি! আবার এখানেই গড়ে উঠেছে ইউরোপিয়ন ক্লাব, খোট্টাবাজার।” এমন একটি সমৃদ্ধশালী শহরের ইতিহাস মানুষকে জানানোর প্রয়োজন রয়েছে বলেই সুকুমারবাবুর মত। চাকরি থেকে অবসরের পরে সেই কাজটি ৭৫ বছরের এই প্রবীণ সযত্নে করে চলেছেন।
১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছে থেকে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানি পায়। সুকুমারবাবু জানাচ্ছেন, বিভিন্ন প্রামাণ্য নথি খতিয়ে জানা গিয়েছে, নবাব সিরাজদৌল্লার পরে ইংরেজদের নির্দেশে মুর্শিদাবাদের তখ্তে থাকা প্রথমে মির জাফর ও পরে তাঁরই জামাতা মির কাশিম রাজনগরের রাজাদের অধিক রাজস্ব আদায়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু রাজনগরের তত্কালীন রাজা আসাদ জামা খাঁ সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। তখন ব্রিটিশ এবং মির কাশিমের সৈন্য একযোগে অভিযান করে রাজনগরের রাজাকে পরাজিত করে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করে। সেটা ছিল ১৭৬০ সাল। মুর্শিদাবাদ থেকে বীরভূমের রাজস্ব আদায়ে সমস্যা এবং রাজনগরের রাজারা স্থানীয় বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হওয়ায় ১৭৮৬ সালে ব্রিটিশরা বিষ্ণপুর ও বীরভূমকে একত্রিত করা হয়। সিউড়িকে তার জেলা সদর হিসাবে বাছা হয়। তবে, প্রথম থেকে সিউড়ি নামকরণ হয়নি। প্রাচীন দলিলে উল্লেখ থাকত লাট হায়দরাবাদ বলে। পরে সিউড়ি হয়েছে। প্রথম কালেক্টর হন সিভিল অফিসার জি আর ফোলি। কিন্তু তিনি খুব সময়ই ওই দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তী কালেক্টর জে শেরবার্ন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু ১৭৮৮ সালের নভেম্বর মাসে দুর্নীতির অভিযোগে ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁকে সরিয়ে দেন। পরবর্তী কালে কালেক্টর হিসেবে সিউড়ির দায়িত্ব নিয়েছিলেন ক্রিস্টোফার কিটিং থেকে সাঁওতাল বিদ্রোহ দমনকারী রিচার্ডসনদের মতো প্রশাসকেরা। দক্ষ প্রশাসক হিসেবে এ শহর পেয়েছে এক বিশিষ্ট বাঙালিকেও। ১৯১৫-’৩৩ সাল পর্যন্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বে থাকা গুরুসদয় দত্ত সিউড়ির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে উদ্দীপ্ত করতে পেরেছিলেন।
শহরের ইতিহাস খুঁড়ে আরও জানা যাচ্ছে, ব্রিটিশ আমলেই ১৮৭৬ সালে আনন্দপুর, নুরাই, তিলপাড়া ও সিউড়ির হাজার সাতের বাসিন্দাদের নিয়ে পুরসভা গঠিত হয়েছিল। বহু পরে অবশ্য তিলপাড়াকে সিউড়ি শহর থকে বাদ দেওয়া হয়েছে। মোটরচালিত গাড়ি পথ চলতে শুরু করার আগে পর্যন্ত গরুগাড়ি আর ঘোড়ার গাড়িই ছিল এ শহরের প্রধান যানবাহন। ১৮৫৯ সালে সাঁইথিয়া থেকে অন্ডাল পর্যন্ত প্রথম রেলযাত্রা শুরু হয়। তথ্য ও সংস্কৃতি ভবনটি তৈরি হয়েছিল ১৮০৬ সালে। প্রথমে ভবনটি রেভেনিউ কালেক্টরের অফিস হিসেবে নির্মিত হলেও পরবর্তী কালে সার্কিট হাউস হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন গ্রন্থাগার। শহরের বহু প্রাচীন মন্দির, মসজিদ, গির্জা ও পিরের আস্তানাও এই শহরের ইতিহাসকে সমৃৃদ্ধ করেছে। আজকের যে চাঁদমারি প্যারেড গ্রাউন্ড (বর্তমানে যেখানে ব্যবহার করে জেলা পুলিশ), সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় আনন্দপুর থেকে সিপাইদের ব্যারাক সরিয়ে এখানেই স্থাপন করা হয়েছিল। মালিপাড়া, বারুইপাড়া, চাঁদনিপাড়া, সেহড়াপাড়া, বেনেপুকুর, টিকাপাড়ার মতো সিউড়ি শহরের বহু পুরনো পাড়াও বিস্মৃতপ্রায় বহু ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। সুকুমারবাবুদের মতো শহরের প্রবীণদের আক্ষেপ, “সাঁওতালদের ভয় দেখানোর জন্য ব্রিটিশরা শহরে ৮-৯টি কামান রেখেছিল। কালেক্টরেট ভবনের সামনেই ছিল সুদৃশ্য ফোয়ারা। প্রশাসনের অবহেলায় সিউড়ির এ রকম বহু ইতিহাসই নষ্ট হয়েছে। এমনটা না হলেই ভাল হতো।” তবু যতটুকু আছে, তা-ও কি আর সংরক্ষণ করা যায় না? বীরভূমের বর্তমান জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলেন, “এমনিতে পূর্ত দফতরের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত ভাবে ভবনগুলি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। তবে, বিশেষ কোনও অভিযোগ এলে স্থাপত্যগুলির ব্যাপারে রক্ষণাবেক্ষণে পদক্ষেপ করা হবে।”