বোলপুরের প্রফেসর কলোনির এই বাড়িতেই ঢুকেছিল ডাকাতের দল। —নিজস্ব চিত্র
বাড়িতে সে দিন হাজির এগারো জন সদস্য। হাসি-ঠাট্টার মধ্যে দিয়ে চলছিল রাতের খাওয়া-দাওয়ার তোড়জোর। পরিবারের এমন প্রাণোচ্ছ্বল ছবিটা নিমেষে বদলে গেল। বাড়ির মধ্যে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল তিন ডাকাত। বন্দুক দেখিয়ে বাড়ির কর্তাদের হাত-পা বেঁধে, মারধর করে শুরু হল লুঠপাট। ঘরের ভিতরে ভয়ার্ত চিৎকার চেঁচামেচি শুনে তত ক্ষণে জড়ো হতে থাকেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বিপদ বুঝে পালানোর তাল করে ডাকাতদল। আর তখনই এক ডাকাতকে জাপটে ধরেছিলেন তিনি। কিন্তু ওই যুবকের পেটে গুলি চালিয়ে পালিয়ে যায় সেই ডাকাত। সেই সাহসী যুবক মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়লেও শেষরক্ষা হয়নি ওই ডাকাতের। বাড়ি থেকে বের হতেই তাকে ধরে ফেলেন জড়ো হওয়া বাসিন্দারা। গণপিটুনিতে সেখানেই প্রাণ হারায় সেই ডাকাত।
চার বছর আগের সেই ভয়াবহ স্মৃতি আজও দগদগে বোলপুরের প্রফেসর কলোনির বাসিন্দাদের। ডাকাতিতে বাধা দিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছিল মুর্শিদাবাদের বছর সাতাশের যুবক সোমনাথ কর্মকারকে (২৭)। গণপিটুনিতে মারা যায় এলাকার দুষ্কৃতী নব বিশ্বাস (৩৫)। বোলপুর শহরের হাইপ্রোফাইল ঘটনার তদন্তে সে দিন ছুটে এসেছিলেন খোদ তৎকালীন ডিআইজি। অথচ সেই মামলা আজও কিনারা করতে পারেনি বীরভূমের পুলিশ। সে দিনের ঘটনায় জড়িত বাকি দুই দুষ্কৃতীকে ধরা দূর অস্ত, তাদের চিহ্নিতও করার কাজটুকুও করতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। যার নিট ফল— পুলিশ ৯০ দিনের মধ্যে চার্জশিট জমা করলেও আজও বিচার পাননি সে দিনের তরতাজা যুবক সোমনাথের পরিবার।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, মুর্শিদাবাদের ভরতপুর থানার চুঁয়াতোড় গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন পেশায় অঙ্কন শিল্পী সোমনাথ। সম্প্রতিই তিনি চাকরি পেয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের বড়ঞার একটি বেসরকারি আর্ট স্কুলে। যাঁর বাড়িতে ডাকাতি হয়েছিল, বিশ্বভারতীর কলাভবনের সেই প্রাক্তন ছাত্র দীপঙ্কর হালদারের আঁকার স্কুলেও সোমনাথ কাজ করছিলেন কয়েক বছর ধরে। সেই সূত্রেই প্রতি শনি ও রবিবার সোমনাথ ওই বাড়ির নীচের একটি ঘরে থাকতেন। দীপঙ্করবাবুর কাছে প্রশিক্ষণ নিতে এলাকার অনেকেই তাঁর বাড়িতে ভিড় করতেন। আঁকার স্কুলটির পাশাপাশি ওই বাড়িতেই ছিল একটি ক্যুরিয়ারের ব্যাবসাও। অনেক রাত পর্যন্ত খোলাই থাকত দীপঙ্করবাবুদের সদর দরজা। ঘটনার দিন ছিল শনিবার। অন্যান্য সপ্তাহের মতো স্কুলের প্রশিক্ষণের কাজে সে দিন রাতে দীপঙ্করবাবুর বাড়িতেই ছিলেন সোমনাথ।
তখন রাত ১১টা। বাড়ির ভিতরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হঠাৎ-ই ঢুকে পড়ে তিন ডাকাত। সোমনাথের ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেয়। দীপঙ্করবাবুর দাদা পার্থ হালদারকেও পিছমোড়া করে দুষ্কৃতীরা বেঁধে ফেলে। দীপঙ্করবাবুর কথায়, ‘‘ওরা মুখোশ পড়েছিল। বন্দুক উঁচিয়ে খাওয়ার ঘরে ঢুকে সকলকে মারধর শুরু করে। চিৎকার করার চেষ্টা করতেই এক জন বন্দুকের বাঁট দিয়ে দিদির (কৃষ্ণাদেবী) মাথায় মারে।’’ বাড়িতে যা টাকাপয়সা, সোনাদানা আছে তা বের করার নির্দেশ দিতে থাকে। ওই সময়ে এক বন্দুকধারী দুষ্কৃতী কৃষ্ণাদেবীর মেয়ে চুমকির হাত থেকে আংটি ছিনিয়ে নিতে গেলে তিনি কোনও ভাবে সেই বন্দুক ডাকাতের হাত থেকে ছিনিয়ে নেন। সেই সুযোগে বাড়ির লোকেরা ওই ডাকাতদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শুরু হয় ধ্বস্তাধ্বস্তি। কৃষ্ণাদেবী বাড়ির বাইরে গিয়ে চিৎকার করে প্রতিবেশীদের ডাকেন। স্থানীয় বাসিন্দারা দরজা খুলে পার্থবাবু ও সোমনাথকে উদ্ধার করেন। সোমনাথরা উপরে ছুটে যান। তাঁদের দাবি, আলমারি ভেঙে টাকা নিয়ে দুই ডাকাত পালিয়ে যায়। সোমনাথ উপরে উঠেই এক জনকে জাপটে ধরে ফেলে। ওই ডাকাতই (নব) সোমনাথের পেটে গুলি করে। বাড়ি থেকে বের হতেই নীচে থাকা জনতা তাকে ধরে ফেলে। শুরু হয় গণপিটুনি। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। আর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা যান সোমনাথ।
এ দিকে, ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছু দূর ধাওয়া করে আর এক ব্যক্তিকেও ডাকাত সন্দেহে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন স্থানীয়রা। যদিও পুলিশের দাবি, আটক করে ওই ব্যক্তিকে জেরা করে ঘটনায় জড়িত হওয়ার কোনও প্রমাণ মেলেনি। তাই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তদন্ত শুরু করলেও বিশেষ এগোতে পারেনি পুলিশ। ঘটনা হল, ঘটনায় মূল অভিযুক্ত নব ছিল এলাকার পুরনো দুষ্কৃতী। একাধিক মামলায় গ্রেফতারও হয়েছে। সে সময় জেলা পুলিশের কিছু অফিসার তাকে ‘সোর্স’ হিসাবেও ব্যবহার করতেন। নবকে একাধিক বার সমাজের মূলস্রোতে ফেরানোর চেষ্টা করে পুলিশ। তাকে পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকানও করে দেওয়া হয়। কিন্তু, ওই ঘটনার আগে পর্যন্ত নবর অপরাধ প্রবণতা যে বিন্দুমাত্র কমেনি, তা আঁচ করতে পারেননি পুলিশকর্তারাও। ফলে সে কাদের সঙ্গী করে দীপঙ্করবাবুদের বাড়িতে ডাকাতির ছক কষেছিল, তার উত্তর পুলিশের কাছে আজও অজানা।
বোলপুর আদালতের সরকারি আইনজীবী ফিরোজকুমার পাল বলছেন, ‘‘ওই মামলায় পুলিশ ৯০ দিনের মধ্যে চার্জশিট জমা করেছিল। পরে একটি রিপোর্টও দেয়। কিন্তু মামলা আর বিশেষ এগোয়নি।’’ বর্তমানে বিচারাধীন ওই মামলার ভবিষ্যত কী, তা নিয়ে বিশেষ সদুত্তর দিতে পারেননি জেলা পুলিশের কর্তারাও। নবকে পিটিয়ে খুনের ঘটনায় পুলিশ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করলেও কাউকে চিহ্নিত করা যায়নি। সে মামলাও বিশেষ এগোয়নি। ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী বৃদ্ধা শান্তিসুধাদেবী বলছেন, ‘‘ভয়ঙ্কর সেই রাতের কথা আর মনে করতে চাই না। শুধু এটুকুই বলব, আর কারও বাড়িতে যেন এমনটা আর না হয়।’’
• ৮ জুলাই ২০১২-র রাত। বোলপুরের প্রফেসর কলোনিতে শিল্পী দীপঙ্কর হালদারের বাড়িতে ঢুকে পড়ে তিন সদস্যের এক ডাকাত দল।
• মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে লুঠপাট শুরু করে মুখঢাকা ডাকাতেরা।
• বন্দুকধারী এক ডাকাতকে জাপটে ধরেন দীপঙ্করবাবুর বন্ধু শিল্পী সোমনাথ কর্মকার (২৭)।
• সোমনাথকে গুলি করে মেরে পালানোর পথে গণপিটুনিতে মারা যায় নব বিশ্বাস (৩৩) নামে স্থানীয় এক দুষ্কৃতী।