কার দখলে বোর্ড? উত্তর মেলার আগে দেওয়ালে জমে উঠেছে লড়াই। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।
দিন যতো এগোচ্ছে ভোটের হাওয়া সরগরম হয়ে উঠছে এই জেলা শহর। প্রার্থী নিয়ে মতান্তরে ক্ষোভে-বিক্ষোভে এক দল থেকে আর এক দলে যাওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলি এখনি দল ভাঙানোর খেলায় নেমেছে। যার ফলে পুরভোটের মনোনয়ন পত্র তোলা, জমা দেওয়া ও মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের অঙ্কে জমজমাট রামপুরহাট। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অঙ্ক যাই হোক, রামপুরহাট পুরবাসী সাফ জানাচ্ছে বার বার বোর্ড ভাঙার খেলায় তারা নারাজ!
পুরভোটের বাজনা বাজতেই রাজ্যে প্রতিটি পুরসভাতে শুরু হয়ে গিয়েছে প্রার্থী নিয়ে জল্পনা। বোর্ড কার হাতে থাকবে, জোট-ঘোঁট হবে কিনা, নাকি সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করবে শাসক দল- এমন নানা প্রশ্ন ঘুরছে ওয়ার্ডের হাওয়ায় হাওয়ায়। এমন ভোট-চর্চা থেকে পিছিয়ে নেই রামপুরহাটও।
রামপুরহাট পুরসভা এবার ১৭ টি ওয়ার্ড থেকে বেড়ে ১৮ টি ওয়ার্ড হয়েছে। এর আগে দুটি বোর্ডে অর্থাত্ ২০০৫-২০১০ এবং ২০১০-২০১৫ তে পুরপ্রধান এবং উপ-পুরপ্রধানকে সরানোর জন্য চারবার পুরবোর্ড ভাঙাগড়ার খেলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কোনও দলের প্রতীকে জিতে না আসা নির্দল কাউন্সিলর-রা কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে জয়ী হলেও, বোর্ড ভাঙা গড়ার খেলায় তাঁরা অংশ নিয়েছেন। এবং তাঁরা যে রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে জয়ী হয়ে এসেছেন, সেই দলের কথাও বেমালুম ভুলে গিয়ে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শহরের বেশ কিছু নাগরিকের অভিমত, “যে সমস্ত নির্দল কাউন্সিলররা বোর্ড ভাঙাগড়ার খেলার নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করে, তাঁদের সেই খেলাটা বন্ধ করা উচিত। এবং ওই সমস্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাঁদেরকে ভাঙাগড়ার খেলায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত নয়।” শহরের বাসিন্দা অশোক সেনগুপ্ত, অলোক চক্রবর্তীর কথায়, “পুর পরিষেবা দিতে স্বচ্ছ পুরবোর্ড হওয়া উচিত। বোর্ড ভাঙাগড়ার খেলা চললে উন্নয়ন ব্যাহত হয়।’’
২০০৫-২০১০ রামপুরহাট পুর-বোর্ডে ১৭ টি ওয়ার্ডে নির্বাচনের ফলাফলে দলগত অবস্থান ছিল বামফ্রন্ট ৭, কংগ্রেস ৪, বিজেপি ৩, নির্দল ২ এবং তৃণমূল ১। এই অবস্থায় বামফ্রন্ট এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ট দল হয়ে পুরপ্রধান পদে লড়াই করেছিল। সিপিএমের অরুপ মুখোপাধ্যায় পুরপ্রধান এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের বন্দনা দত্ত উপ-পুরপ্রধান হয়েছিলেন। ঘটনা হল, পুরপ্রধানের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কাউন্সিলরদের একাংশ পুর উন্নয়নকে ব্যাহত করে নিজেদেরকে অন্তর্ধানে রেখে বোর্ড ভাঙার খেলায় নেমে পড়ে। এরফলে পুরপ্রধান হয় কংগ্রেসের সৈয়দ সিরাজ জিম্মি এবং উপ-পুরপ্রধান হন তৃণমূলের সোমেন ভকত (টিঙ্কু)। সেবারে নির্দল কাউন্সিলর হিসাবে বোর্ড ভাঙাগড়ার খেলায় নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন ২নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন এবং বর্তমান তৃণমূল পুরপ্রধান, তখনকার সময়ে নির্দল কাউন্সিলর অশ্বিনী তিওয়ারি।
২০১০-২০১৫ সালেও বোর্ড ভাঙা-গড়ার খেলাতেও এই দুই নির্দল কাউন্সিলই বোর্ড ভাঙা-গড়ার খেলায় আবারও নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই মেয়াদে ১৭ টি ওয়ার্ডে দলগত অবস্থান ছিল তৃণমূল ৮, বামফ্রন্ট ৩, কংগ্রেস ২, বিজেপি ২, নির্দল ২। তৃণমূল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ট দল হিসাবে বোর্ড গঠনের দাবিদার হয়। তৃণমূলের পুরপ্রধান হন নির্মল বন্দ্যোপাধ্যায়। উপ-পুরপ্রধান তৃণমূলের আব্বাস হোসেন। আবারও বোর্ড ভাঙা-গড়ার খেলা শুরু হয়। এবং সেই খেলায় তৃণমূলের অন্দরমহলের গোষ্ঠী কোন্দলে নির্মল বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরিয়ে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের নির্দল কাউন্সিলর অশ্বিনী তিওয়ারি পুরপ্রধান হন। এবং উপ-পুরপ্রধান পদ থেকে তৃণমূলের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্বাস হোসেনকে সরিয়ে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর অনিন্দ্য কুমার সাহাকে উপ-পুরপ্রধান করা হয়।
পুরসভায় বিগত দশ বছরের এই বোর্ড ভাঙা-গড়ার খেলার বিশ্লেষন করতে গিয়ে সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সঞ্জীব বর্মন বলেন, “২০০৫- ১০ সালে নির্বাচনের ফলে বামফ্রন্ট একক ভাবে এক তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে পুরপ্রধান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। সেখানে অন্য দলের কাউন্সিলররা আমাদের সমর্থনও করে। কিন্তু, যখন পুরসভার উন্নয়ন শুরু হল, তখনই অনৈতিক ভাবে বামফ্রন্ট পুরপ্রধানকে সরিয়ে দেওয়া হয়।”
বিজেপি-র বর্তমান জেলা সহ-সভাপতি শুভাশিষ চৌধুরী। ২০০৫- ১০ সালে তিনি নিজে এবং দলীয় আরও দু’ জন কাউন্সিলরকে নিয়ে দেখা গিয়ে ছিল বোর্ড ভাঙা-গড়ার খেলায়। ২০০৫-১০ এবং ২০১০-১৫ সালে এই দুই পুরবোর্ডে বোর্ড ভাঙা-গড়ার খেলা নিয়ে শুভাশিষবাবুর বিশ্লেষণ, “বিগত দশ বছরে বামফ্রন্ট এবং তৃণমূল-এর তরফে পুরপ্রধানের যে মুখ, জনগণের সামনে সঠিক ভাবে উঠে আসেনি। দুটো দল থেকে আগাম কাউকে পুরপ্রধান হিসাবে ঘোষণা করা হয়নি। যার জন্য একাধিক বার বোর্ড ভাঙা ও গড়া হয়েছে।”
রামপুরহাট পুরসভার ছ’বারের কাউন্সিলর তথা প্রাক্তন পুরপ্রধান এবং বীরভূম জেলা কংগ্রেসের সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মি অবশ্য বারবার পুরবোর্ড ভাঙা ও গড়াকে ‘খেলা’ বলতে নারাজ। তাঁর দাবি, “যখন কেউ তাঁর পদে থেকে উন্নয়ন না করে দুর্নীতি করেন, তখন তাঁর প্রতি সকলের ক্ষোভের সঞ্চার হয়। আর এই ক্ষোভ থেকেই আস্থা হারানোর বিষয় উঠে আসে। এবং তখন তাঁর প্রতি অনাস্থা দেখায় মানুষজন। সেটা কোনওভাবেই ভাঙা- গড়ার খেলা নয়।”
আসলে, এ বারের পুরসভা নির্বাচন অন্য পাঁচটা নির্বাচনের চেয়ে আলাদা। তার কারণ ব্যাখ্যায় রাজ্যের শাসক দলের পক্ষে রামপুরহাট পুরসভার ভোটে গঠিত তৃণমূলের কোর কমিটির আহ্বায়ক অশোক চট্টোপাধ্যায় বলেন, “কারণ, দল এখন রাজ্যে ক্ষমতায়। সেক্ষেত্রে দলীয় প্রভাব এবং সংগঠিত শক্তি দিয়ে মিলিত ভাবে তৃণমূল কর্মীরা এক ইঞ্চি জমি না ছেড়ে এবারে নির্বাচনে লড়বে। আর পুরসভা যে উন্নয়ন করেছে, সেই উন্নয়নমূলক কাজ গুলিকে হাতিয়ার করে আমরা মানুষের কাছে ভোট চাইব।” এ বারের পুরভোটে তিনবারের নির্দল কাউন্সিলর অশ্বিনী তিওয়ারি তৃণমূলের হয়ে আগের তিনবারের ওয়ার্ড ৭ নম্বর থেকেই লড়ছেন। কী বলছেন তিনি? গতবার কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল ছেড়ে এবারে তৃণমূলেই বা কেন?
বিদায়ী পুরপ্রধানের জবাব, “এলাকার মানুষ যেমন চাইছেন, সেই ভাবে লড়াই করতে হচ্ছে!”