এই সেই লটারির দোকান। (ডান দিকে) রামপ্রসাদবাবুর বাড়ি। মঙ্গলবার সকালে। ছবি: অনির্বাণ সেন
পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে খুন হয়েছে বিকাল সাড়ে ৫টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার মধ্যে। আর সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ স্থানীয় একটি লটারির দোকানে আড্ডা মারতে দেখা গিয়েছে অভিযুক্ত রামপ্রসাদ সাহাকে।
মহম্মদবাজারে জোড়া হত্যা-কাণ্ডে উঠে এল এমনই তথ্য। মহম্মদবাজারে বাসস্টপের কাছে ওই লটারির দোকানের মালিক বিমান সাহা নামে এক ব্যক্তি। মঙ্গলবার তাঁর দোকানের কর্মী বিশ্বনাথ মণ্ডল দাবি করেন, ‘‘রামপ্রসাদবাবু প্রায় দিনই সন্ধ্যায় দোকানে আসতেন। লোকেদের সঙ্গে আড্ডা মারতেন। ঘটনার দিন ৭টা নাগাদ দোকানে এসেছিলেন। ৭টা ১৫-২০ মিনিট ওঁর মোবাইল একটি ফোন আসে। দু’তিন মিনিট কথা বলে ফোন রেখে কাউকে কিছু না জানিয়েই চলে যান।’’ বিশ্বনাথবাবু পরে জানতে পারেন রামপ্রসাদবাবুর দুই ভাগ্নির খুনের কথা। সেই তাঁকেই কেন পুলিশ ওই খুনের ধরল, তার উত্তরটা অবশ্য এখনও পরিষ্কার নয় বিশ্বনাথবাবুর কাছে। তবে তাঁর ধারণা, খুনের খবর দিতেই ফোন আসে রামপ্রসাদবাবুর কাছে। তবে সে দিনের ফোনটি কার ছিল, তা অবশ্য বিশ্বনাথবাবুর পক্ষে বলা সম্ভব হয়নি।
রামপ্রসাদবাবু যদিও ঘটনার দিনই দাবি করেছিলেন, দিদি অপর্ণা সাধুর ফোন পেয়েই তিনি জাতীয় সড়কের ধারে কাঁইজুলি এলাকার ওই বাড়িটিতে ছুটে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে একটি ঘরে ছোট ভাগ্নি পুষ্পিতার গলা কাটা দেহ দেখার পরে তিনিই বড় ভাগ্নির খোঁজ করেন। তার পরেই দোতলার সিঁড়ির মুখে সুস্মিতার গলা কাটা দেহ মেলে। কিন্তু, এ দিন ওই লটারির দোকানের কর্মীর দাবি থেকে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে এসেছে। প্রথমত, পুলিশের দাবি খুনের সময়পর্বে (অর্থাৎ বিকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত) রামপ্রসাদবাবুর মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। তা হলে বিশ্বনাথবাবুর দাবি অনুযায়ী সওয়া ৭টা নাগাদ রামপ্রসাদবাবুর মোবাইলে ফোন এল কী করে? দ্বিতীয়ত, কেউ কাউকে খুনের প্রথম খবর দিলে ২-৩ মিনিট ধরে কথা বলাটা কি অস্বাভাবিক নয়? বরং খবর পেয়ে আশপাশের লোকেদের জানিয়ে ঘটনাস্থলে ছোটাটাই বেশি স্বাভাবিক ছিল বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তাই বিশ্বনাথবাবুর বর্ণনা অনুযায়ী, ঘটনার দিন লটারির দোকানে রামপ্রসাদবাবুর ফোনের কথোপকথন আরও রহস্য বাড়িয়েছে এই জোড়া হত্যা-কাণ্ডে।
রহস্য যতই ঘনাক, তাঁর স্বামী কোনও ভাবেই ওই খুনে যুক্ত নন বলে মনে করেন ধৃত রামপ্রসাদবাবুর স্ত্রী চুমকিদেবী। রবিবার রাতে নিজেরই ভাগ্নিদের খুনে তাঁকে গ্রেফতার করার খবর শোনার পর থেকে কার্যত বিছানা নিয়েছেন তিনি। নাওয়া-খাওয়া, ঘুম সবই ছুটেছে। এ দিন সকাল ৯টা নাগাদ রামপ্রসাদবাবুর টিনের ছাউনি দেওয়া বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বারান্দার এক কোণে ছোট্ট একটা চৌকিতে শুয়ে আছেন চুমকিদেবী। তিন বছরের শিশুকে নিয়ে প্রায় দিশাহারা চুমকিদেবী কোনও রকমে বললেন, ‘‘সম্পত্তি নিয়ে দিদির আমার স্বামীর কোনও বিরোধ ছিল না। আমার স্বামী দুই ভাগ্নিকে নিজের ছেলের চেয়েও বেশি ভালবাসত। আর তাঁকেই কিনা পুলিশ খুনি সাজিয়ে দিল!’’ তাঁর দাবি, যে চটির কথা বলা হচ্ছে, তা তাঁর স্বামীর নয়। মোবাইল ফোন বন্ধ থাকা নিয়ে অবশ্য তিনি কিছু জানেন না বলেই দাবি করলেন। তাঁর অভিযোগ, খুনের কোনও কিনারা করতে না পেরেই পুলিশ তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা সাজাচ্ছে।
চুমকিদেবী এমন দাবি করলেও মেয়েদের খুনের পিছনে রামপ্রসাদবাবুকেই সন্দেহ করছেন দেবাশিসবাবু। এ দিন সকালে এসেছিলেন স্ত্রী অপর্ণাদেবীর সঙ্গে দেখা করতে। গত শুক্রবার থেকেই পুলিশ তাঁকে থানায় আটক করে রেখেছে। এ দিন থানার ক্যান্টিনে বসে তিনি বলেন, ‘‘আমি এক জন সর্বহারা বাবা। মেয়েদের কাজের জন্য ক্ষৌরকর্ম করাতে ঘাটে যাব। তাই থানায় এসেছিলাম, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। কিন্তু পুলিশ ওকে ছাড়ছে না।’’ দেবাশিসবাবু দাবি করলেন, ‘‘আমার সঙ্গে স্ত্রীর অনেক দিনের ভালবাসার সম্পর্ক। কোনও মা তার নিজের সন্তানদের এ ভাবে মারতে পারে না। আমার বিশ্বাস আমার স্ত্রী এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয়।’’ যদিও সম্পত্তির কারণে রামপ্রসাদবাবুই বা কেন দুই ভাগ্নিকে খুন করবেন, তার উত্তর না দিয়েই একা ঘাটের দিকে রওনা দিলেন।
অন্য দিকে, এ দিনও সকাল থেকে বন্ধ ছিল মহম্মদবাজার থানার গেট। বেলা ১১টা নাগাদ থানায় আসেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায়। কিছু ক্ষণ পরে এসে পৌঁছন সিউড়ি মহিলা থানার আইসি অনিন্দিতা সাহামজুমদার। পুলিশ সূত্রের খবর, দু’জনেই পৃথক ভাবে ধৃত রামপ্রসাদবাবু, আটক অপর্ণাদেবী এবং অপর্ণাদেবীর পরিচিত সুধীর মণ্ডলকে জেরা করেন। দুপুর পৌনে ৩টে নাগাদ দু’জনেই সিউড়ি ফিরে যান। তবে, তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে এ দিনও মুখে কুলুপ এঁটেছেন পুলিশ আধিকারিকেরা। ওসি থেকে এসপি, কেউ-ই ফোন ধরেননি। পুলিশের এই মৌনতা রহস্য বাড়িয়েছে আরও।