একসাথে: বাবা-মায়ের বিয়ের আনুষ্ঠানে সাক্ষী সন্তানেরা। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম
টোপর পরা মায়ের কোলে দু’বছরের ছেলে। পাশে বরের সাজে বাবা। বিয়ের মণ্ডপ থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তাঁদের চার বছরের মেয়ে। আর তিন বছরের মেয়েটি বিয়ের আসরে বসে থাকতেই থাকতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। দুই মেয়ে, এক ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ে করতে বসেছেন রামপুরহাট থানার ঠাকুরপুরা গ্রামের বুড়ো টুডু। পাশে বছর পাঁচেক আগে পরিচিত জীবনসঙ্গী ঝাড়খণ্ডের দুমকার জামার সোহাগিনী কিস্কু।
তাঁদের মতোই ২১ জোড়া আদিবাসী নরনারী, বহুদিন ধরে এক সঙ্গে ঘর করলেও যাঁরা আনুষ্ঠানিক বিয়ে করতে পারেননি, তাঁদের ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে বিয়ে দেওয়া হল। রবিবার এই বিয়ের আসর বসেছিল মল্লারপুরে। নেপথ্যে মল্লারপুরের পূর্বাঞ্চল কল্যাণ আশ্রম।
ওই সংস্থার বীরভূম জেলা সম্পাদক বিশ্বনাথ দে বলেন, ‘‘আদিবাসী সমাজের মধ্যে অনেকেই দাম্পত্য জীবন শুরু করলেও অভাবের কারণে বিয়ের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানটুকু করতে পারেন না। নিজস্ব পরম্পরা ও আদিবাসী সমাজের রীতি অনুসারে বৈবাহিক অনুষ্ঠান না হওয়ার, তাঁদের সামাজিক স্বীকৃতি অধরা থেকে যায়। এর ফলে তাঁরা সামাজিক এবং কিছু মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে সমস্যায় পড়েন। তাই তাঁদের পাশে দাঁড়াতেই এই উদ্যোগ।’’ পূর্বাঞ্চল কল্যাণ আশ্রমের পূর্ব ভারতের শ্রদ্ধাজাগরণ প্রমুখ অশোক জানা, পূর্বাঞ্চল কল্যাণ আশ্রমের দক্ষিণবঙ্গ-সহ সংগঠন সভাপতি মহাদেব গড়াই জানান, আদিবাসী সমাজের রীতি অনুযায়ী পাত্র ও পাত্রীর উভয়পক্ষের মাঝিহারাম বা পুরোহিতদের উপস্থিতিতে এবং তাঁদের সাক্ষরের মাধ্যমে এই বিবাহ করা হয়েছে। বর-কনেকে সংস্থার তরফে পোশাক, পাত্রীর রূপচর্চার সরঞ্জাম, প্লাষ্টিকের মাদুর, মশারি, বিছানার চাদর, স্টিলের থালা-বাটি-গ্লাস ও টিনের একটি বড় বাক্স দেওয়া হয়। তাঁদের এই উদ্যোগের খবর শুনে কলকাতার বাগবাজারের বাসিন্দা সত্যব্রত গোয়েল বিয়ের সমস্ত খরচ দিয়েছেন।
রামপুরহাট থানার কাপাশটুলো গ্রামের পঞ্চান্ন বছরের ছুতোর বাসকি জানান, প্রায় দশ বছর ধরে নিজেদের মধ্যে দাম্পত্য জীবন পালন করলেও সমাজের রীতি মেনে তিন দিন ধরে গ্রামশুদ্ধ লোককে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো থেকে মদের খরচ জোগাড় করতে না পেরে, এতদিন বিয়ের অনুষ্ঠান করতে পারেননি। পাশে বসা শ্রীমতি হাঁসদা বলেন, ‘‘আমাদের কোনও সন্তান নেই। তবুও সমাজে মিশতে হবে, তাই এ দিন স্বামী-স্ত্রী’র স্বীকৃতি পেয়ে ভাল লাগছে।’’
বীরভূম জেলা ছাড়াও পাশের জেলা মুর্শিদাবাদ, এমনকী ঝাড়খণ্ড থেকেও পাত্র-পাত্রীরা এসেছিলেন। তাই ‘সুগনা বাপলা’ বা শুভবিবাহের অনুষ্ঠানকে ঘিরে মল্লারপুর পূর্বাঞ্চল কল্যাণ আশ্রমের মধ্যে ৫০০০ বর্গফুট বিয়ের মণ্ডপ সেজে উঠেছিল উৎসবের মেজাজে। জাতীয় সড়কের ধার থেকে আশ্রম প্রাঙ্গণ পর্যন্ত দলে দলে আদিবাসী পুরুষ-মহিলা ধামসা, মাদলের তালে নাচলেন। বিয়ে শেষে এক সঙ্গে পাত পেরে খেলেন ভাত, ডাল, সব্জি, চাটনি ও মিষ্টি। ভোজ শেষে আবার সেই চেনা ঠিকানায় ফিরলেন বুড়ো-সোহাগিনীরা। মুখে একগাল হাসি।