পুরুলিয়া বিধানসভা কেন্দ্র

বছর ঘুরতেই শহরের মন হারাল তৃণমূল

পুরসভা দখলে রেখেও একবছরেই অধিকাংশ পুরবাসীর মন হারিয়েছে তৃণমূল। পুরুলিয়া কেন্দ্রে দলের বিপর্যয়ের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব দেখতে পাচ্ছেন, পুরুলিয়া শহরের একটা বড় অংশের বাসিন্দা তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অথচ একবছর আগে ২০১৫ সালে এই পুরশহরের ২৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টি দখল করেছিল তৃণমূল। কিন্তু বছর ঘুরতেই বিধানসভা ভোটের ফল বেরোতেই দেখা যাচ্ছে উল্টো ছবি। শহরেই পিছিয়ে পড়েছে তৃণমূল। গ্রামাঞ্চলেও তৃণমূলের ভোটপ্রাপ্তি বেশ কমেছে। এর কারণ হিসেবে দলের সামনে আসছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা।

Advertisement

প্রশান্ত পাল

পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৬ ০১:৫০
Share:

পুরসভা দখলে রেখেও একবছরেই অধিকাংশ পুরবাসীর মন হারিয়েছে তৃণমূল।

Advertisement

পুরুলিয়া কেন্দ্রে দলের বিপর্যয়ের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব দেখতে পাচ্ছেন, পুরুলিয়া শহরের একটা বড় অংশের বাসিন্দা তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অথচ একবছর আগে ২০১৫ সালে এই পুরশহরের ২৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টি দখল করেছিল তৃণমূল। কিন্তু বছর ঘুরতেই বিধানসভা ভোটের ফল বেরোতেই দেখা যাচ্ছে উল্টো ছবি। শহরেই পিছিয়ে পড়েছে তৃণমূল। গ্রামাঞ্চলেও তৃণমূলের ভোটপ্রাপ্তি বেশ কমেছে। এর কারণ হিসেবে দলের সামনে আসছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা।

পুরুলিয়ার পুরপ্রধান তৃণমূলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি কে পি সিংহদেও। তিনিই গতবারে এই বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন। এ বার তৃণমূল তাঁর ছেলে দিব্যজ্যোতিপ্রসাদ সিংহ দেও-কে প্রার্থী করেছিল। আর তাঁর বিরুদ্ধে জোটের প্রার্থী করা হয় একসময় তৃণমূলের পরিচিতমুখ অধুনা কংগ্রেসের সুদীপ মুখোপাধ্যায়কে। ফলে লড়াইটা এ বার ছিল, তৃণমূলের জেলার হেভিওয়েট নেতার ছেলের সঙ্গে শাসকদলেরই একসময়কার ঘরের ছেলের। ফল কি হয় তাই জানতে মুখিয়ে ছিলেন অনেকেই।

Advertisement

বস্তুত পুরুলিয়া বিধানসভা কেন্দ্র যে এ বার তৃণমূলের পক্ষে খুব স্বস্তির ছিল না, তার আঁচ পাওয়া গিয়েছিল দু’বছর আগের লোকসভা ভোটের ফলাফলেই। সে বার তৃণমূলের ভোট ছিল ৬৫,২৭৫। আর বামফ্রন্টের পক্ষে ভোট ছিল ৩৮,৫১৫টি এবং কংগ্রেসের প্রাপ্তি ছিল ৪০,৭২৫টি। অর্থাৎ এ বারের বিরোধী জোটের হিসেবে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মিলিত ভোট ৭৯,২৪০। যা তৃণমূলের থেকে অনেক বেশি।

তবু তৃণমূলকে কিছুটা ভরসা বাড়িয়েছিল, গত বছরের পুরনির্বাচনের ফল। সে বার পুরুলিয়া শহরের ২৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টি দখল করে তৃণমূল। সেই জোরেই তৃণমূল নেতৃত্ব আশা করেছিলেন, ব্যবধান কমলেও বিধানসভা ভোটে পুরুলিয়া কেন্দ্রটি তাঁদের দখলেই থাকছে।

কিন্তু বিধানসভা ভোটে সেই লোকসভা ভোটেরই ছায়া পড়েছে। জোটপ্রার্থী ভোট পেয়েছেন ৮১,৩৬৫ আর তৃণমূল প্রার্থী পেয়েছেন ৭৬,৪৫৪। ব্যবধান ৮,৯১১। অথচ পাঁচবছর আগে এই কেন্দ্রেই কে পি সিংহদেও ২৬,৪৮৭ ভোটের ব্যবধান নিয়ে বিধানসভায় গিয়েছিলেন।

এ বার ইভিএম খুলতেই দেখা যায়, এই শহরে যে ১৫টি ওয়ার্ড তৃণমূলের দখলে রয়েছে, তার মধ্যে পাঁচটি ওয়ার্ডেই লিড নেই তৃণমূল প্রার্থীর! দেখা গিয়েছে তৃণমূল প্রার্থী শহরের যে ১১টি ওয়ার্ডে লিড পেয়েছেন, তার মধ্যে একটি কংগ্রেসের দখলে থাকা (১০ নম্বর ওয়ার্ড)। তৃণমূলের দখলে থাকা ৪, ৬, ৯, ১৮ ও ২০ এই পাঁচটি ওয়ার্ডে পিছিয়ে পড়া হারের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন নেতৃত্ব। শুধু শহরেই নয়, এই কেন্দ্রের মানচিত্রে থাকা পুরুলিয়া ২ ও পুরুলিয়া ১ ব্লকের দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাতেও পিছিয়ে পড়েছে তৃণমূল। পুরুলিয়া ২ ব্লকের সমস্ত গ্রাম পঞ্চায়েতই রয়েছে তৃণমূলের দখলে। রয়েছে পঞ্চায়েত সমিতিও। জেলা পরিষদের এলাকার দুই সদস্যও তৃণমূলের। তবু এই ব্লক থেকে প্রায় ২২০০-র বেশি ভোটে পিছিয়ে পড়তে হয়েছে তৃণমূলকে।

ভোটের ফলপ্রকাশের পর দিন দশেক কেটে গেলেও আলোচনা থামতে চাইছে না। পুরুলিয়া শহর ও ব্লক এলাকায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই যে দলকে ডুবিয়েছে, আড়ালে হলেও সে কথা মানছেন অনেকেই। দিব্যজ্যোতি নেতার ছেলে হলেও সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। দলনেত্রী তাঁকে প্রার্থী করায় ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলেননি। তাই যেখানে এ বার মাটি কামড়ে লড়াইয়ের প্রয়োজন ছিল, সেই ছবি দেখা যায়নি বলে মানছেন দলেরই একাংশ। যদিও তা মানতে নারাজ দলের শহর কমিটির সভাপতি বৈদ্যনাথ মণ্ডল। ভোটের আগেই তিনি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ কাউন্সিলরদের সঙ্গে সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে হস্তক্ষেপ করা নিয়ে পুরপ্রধানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধে। পরে অবশ্য বৈদ্যনাথবাবুরা পুরপ্রধানের ছেলের ভোটের প্রচারে নেমেছিলেন। তিনি দাবি করছেন, ‘‘দলের প্রার্থীকে জেতাতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।’’

একদিকে তৃণমূলের প্রার্থী নিয়ে দলেই যেখানে কিছুটা অসন্তোষ ছিল, সেখানে প্রার্থী বাছাইয়ে জোট এক কদম এগিয়ে গিয়েছিল বলে মনে করছেন রাজনীতি নিয়ে ওয়াকিবহাল লোকজন। কারণ সুদীপবাবু তৃণমূলের কিছু নেতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে দলত্যাগ করায় তাঁর প্রতি শাসকদলের একাংশের সহানুভূতি ছিলই। তার উপরে জোটপন্থী কংগ্রেস ও বামেদেরও এই কেন্দ্রে ভালই সমর্থন রয়েছে। ফলে তাঁকে প্রার্থী করায় ওই তিনপক্ষকে পাশে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। হয়েছেও তাই।

অন্যদিকে, পুরুলিয়া ২ ব্লকের সাংগঠনিক দায়িত্ব রয়েছেন খোদ কে পি সিংহ দেও। কিন্তু পুরসভায় পুরপ্রধানের দায়িত্বের চাপে ও দুর্গাপুজোর পর থেকে তিনি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওই এলাকায় সাংগঠনিক কাজে তার কিছু প্রভাব পড়ে। তাঁর অনুগামীরা ভোটের আগে হাল ধরার চেষ্টা করলেও ততদিনে জোটপ্রার্থী ওই এলাকার হাওয়া নিজের পালে টেনে নিয়েছেন।

জোটপন্থীদের দাবি, গ্রামীণ এলাকায় একশো দিনের কাজের প্রকল্পে শ্রমিকদের মজুরির টাকা বকেয়া থাকা, ইন্দিরা আবাস প্রকল্প থেকে বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগকে যে ভাবে তাঁরা মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছেন, তৃণমূল পাল্টা প্রচারে তার জবাব দিতে পারেনি। পলাশ দাস নামে এক জোট কর্মীর কথায়, ‘‘আমরা সারদা-নারদ নিয়ে মাথা ঘামাইনি। পঞ্চায়েতের দুর্নীতির অভিযোগগুলিকেই মানুষের কাছে তুলে ধরেছিলাম। ফলও পেয়েছি।’’

অন্য দিকে, চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তৃণমূলের শহর সভাপতি বলছেন, ‘‘তৃণমূলের জেতা পাঁচটি ওয়ার্ডে দলের ফল খারাপ যেমন হয়েছে, তেমনই কয়েকটি ওয়ার্ডে লিড পেলেও তা খুবই কম। দেখা গিয়েছে শহরের বস্তি অধ্যুষিত ওয়ার্ডগুলিতে তৃণমূল লিড পায়নি। বুঝতে পারছি জলের সমস্যা একটা প্রভাব ফেলেছে।’’ আর কে পি সিংহ দেও বলছেন, ‘‘হারের কারণ পর্যালোচনা হবে।’’ দলের জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো বলেন, ‘‘পুরুলিয়ায় ফল কেন খারাপ হল খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর কারণ দলকে জানাতে হবে।’’ দল সূত্রের খবর, রিপোর্টে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়-কাণ্ডে দলের ভাবমূর্তিতে ধাক্কা, কাউন্সিলরদের একাংশের সঙ্গে পুরপ্রধানের দূরত্বের বিষয়টিও থাকতে পারে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement