চণ্ডীদাস মন্দির। নানুর। — নিজস্ব চিত্র।
জয় এল রেকর্ড মার্জিনে। কিন্তু তার পরেও নানুর বিধানসভা কেন্দ্রে শাসকদলের ‘অস্বস্তির কাঁটা’ হয়ে রইল দুই পঞ্চায়েত। কারণ, এত চেষ্টার পরেও ওই দুই পঞ্চায়েতে তাদের পিছনে ফেলে দিয়েছে বিজেপি।
এ বারের নির্বাচনে নানুর কেন্দ্রে ভাল ফল করা জেলা সভাধিপতি কাজল শেখের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ, এর সঙ্গে তাঁর ‘গ্রহণযোগ্যতা’ প্রমাণের প্রশ্ন জড়িয়ে গিয়েছিল। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বারের লোকসভা নির্বাচনে কাজলকে নানুর এবং কেতুগ্রাম বিধানসভা এলাকা দেখার দায়িত্ব দেন। তার উপরে পাপুড়িতে সভা করতে এসে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নানুরে সর্বাধিক লিডের দাবি করে যান। স্বভাবতই নানুরে সর্বোচ্চ লিড কাজলের কাছে পাখির চোখ হয়ে ওঠে। ফল বেরোলে দেখা গেল সে কাজে সফল হয়েছেন কাজল। তবে ভাল ফল যে আসতে পারে, তা ভোটের পরের দিন পাপুড়িতে তৃণমূলের বিজয় মিছিলেই মালুম হয়েছিল। যদি সেটি যে বিজয় মিছিল ছিল তা স্বীকার করেননি কাজল।
দলীয় সূত্রের খবর, কাজলের সঙ্গে দলের কোর কমিটির সদস্যদের একাংশের খুব একটা সৌহার্দ্য ‘নেই’। তাদের ‘দেখিয়ে’ দেওয়ার এমন সুযোগ পুরো মাত্রায় কাজে লাগাতে এ বার নির্বাচনী ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। ফলে, নানুর থেকে প্রায় ৮০ হাজার ভোটে লিড পেয়েছেন দলীয় প্রার্থী অসিত মাল। এর আগে ওই কেন্দ্র থেকে এত ‘বিপুল’ ভাবে কোনও প্রার্থী এগিয়ে গিয়েছেন কি না মনে করতে পারছেন না রাজনৈতিক মহল। বার বার ফোন করে এবং মেসেজ পাঠিয়ে কাজলের কোন প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
তবে এই সাফল্যের মাঝেও শাসকদলের কাছে ‘অস্বস্তির কাঁটা’ হয়ে রয়েছে দু’টি পঞ্চায়েত। নানুর বিধানসভার মধ্যে নানুরের ১১টি এবং বোলপুরের ছ’টি পঞ্চায়েত পড়ে। তার মধ্যে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে নানুরের বড়া-সাওতা, উচকরণ, দাসকলগ্রাম-কড়েয়া-১, কীর্ণাহার-১ এবং কীর্ণাহার-২ পঞ্চায়েতে বিজেপির থেকে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। বোলপুরের কঙ্কালীতলা, সর্পলেহনা-আলবাধা এবং কসবা পঞ্চায়েতেও পিছিয়ে ছিল শাসকদল। এ বারের লোকসভা নির্বাচনে এই পঞ্চায়েতগুলির ছ’টিতে লিড পেলেও কীর্ণাহার-১ এবং দাসকলগ্রাম-কড়েয়া ১ পঞ্চায়েতে বিজেপিকে পিছনে ফেলতে পারেনি শাসকদল। উল্টে কীর্ণাহার-১ এগিয়ে থাকার ব্যবধান বাড়িয়ে নিয়েছে বিজেপি।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পঞ্চায়েত ভিত্তিক ফলাফলের নিরিখে কীর্ণাহারে প্রায় ৯০০টি ভোটে পিছিয়ে ছিল শাসকদল। এ বারে প্রায় ১,৯৮৩টি ভোটে পিছিয়ে রয়েছে তারা। দাসকলগ্রাম-কড়েয়াতে অবশ্য ব্যবধান কমেছে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তারা ১,৫৮৫ ভোটে পিছিয়ে ছিল। এ বারে সেই ব্যবধান কমে দাঁড়িয়েছে ৬০৯টিতে।
রাজনৈতিক মহলের মতে, ওই দু’টি পঞ্চায়েতে শাসকদলের পিছিয়ে থাকার পিছনে মূলত দু’টি কারণ রয়েছে। একটি কারণ হল, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। দলীয় সূত্রের খবর, দলের জেলা কোর কমিটিতে কাজলের অন্তর্ভুক্তির পরে ওই এলাকার অনুব্রত অনুগামীরা ‘কোণঠাসা’ হয়ে পড়েন। তাঁদের অনেকেই ‘পদচ্যুত’ করে কাজল ‘অনুগামীদের’ বসানো হয়। এমনকি, কাজলের বিরুদ্ধে কীর্ণাহারের দলীয় কার্যালয়ে তালা ঝোলানোরও অভিযোগ ওঠে। এই কর্মীরা এ বার ‘ব্রাত্য’ ছিলেন বলে অভিযোগ।
দ্বিতীয়, কারণটি হল সংখ্যালঘু ভোট। ভোট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কের অন্যতম ‘অংশ’ সংখ্যালঘু ভোট। অন্য জায়গার তুলনায় ওই দুই পঞ্চায়েত এলাকায় সংখ্যালঘু ভোট অপেক্ষাকৃত কম। কীর্ণাহারে প্রায় ২০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট রয়েছে। দাসকলগ্রাম-কড়েয়াতে মেরেকেটে ২-৩ শতাংশ। ওই ভোটের একটা অংশ এ বারে আবার টেনে নিয়েছে সিপিএম।
তৃণমূলের ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য অবশ্য গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ওই পঞ্চায়েত এলাকার কর্মীরা মানুষের কাছে রাজ্য সরকারের প্রকল্পগুলির কথা ঠিকঠাক তুলে ধরতে পারেননি। সে জন্যেই আমরা পিছিয়ে পড়েছি বলে মনে হয়। তবুও পিছিয়ে পড়ার কারণ পর্যলোচনা না করে নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যাবে না।’’
বিজেপির সাংগঠনিক জেলা সভাপতি (বোলপুর) সন্ন্যাসীচরণ মণ্ডল বলেন, ‘‘ওই দুই পঞ্চায়েত এলাকায় আমরা শাসকদলের সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে পেরেছিলাম। মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পেরেছেন। অন্য জায়গায় মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারলে রেকর্ড লিডের বড়াই করা ঘুচে যেত।’’