আরজিকরের ঘটনায় পথ নাটিকার মাধ্যমে পুরুলিয়া দেবেন মাহাতো মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ডাক্তারি পড়ুয়াদের নিজস্ব চিত্র।
আর জি কর কাণ্ড শুধু ঘটি-বাঙাল নয়, ভেদ রেখা মুছে দিয়েছে সমাজের অনেকে ক্ষেত্রের। শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ ঘিরে শিক্ষকদের একাংশের বিরুদ্ধে যে সন্দেহ জেগেছিল, ধীরে ধীরে সেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করেছে। আর তা অনেকাংশে সম্ভব হয়েছে আর জি কর কাণ্ডে প্রতিবাদী পড়ুয়াদের পাশে শিক্ষকদের উপস্থিতি।
স্কুল পড়ুয়াদের মিছিল রুখতে কখনও জেলা, কখনও রাজ্য শিক্ষা দফতর বিভিন্ন নির্দেশিকা পাঠিয়েছে। তবুও বহু স্কুলের পড়ুয়ারা পথে নামতে দু’বার ভাবেনি। পুরুলিয়া জেলার কিছু স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানাচ্ছেন, পডুয়ারা রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, তাদের আন্দোলনে শিক্ষকেরা পাশে না থাকলে আগামী দিনে স্কুলের অনুষ্ঠান তারা একপ্রকার বয়কট করবে। ওই সব স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, ওই উদাহরণেই স্পষ্ট।
বেশ কিছু স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা আবার জানাচ্ছেন, আর জি করের ঘটনায় পথে নামার প্রয়োজনীয়তা বুঝে তাঁরাও পড়ুয়াদের সঙ্গে মিছিলে শামিল হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই আবার দেখা গিয়েছে, আর জি করের ঘটনার বিরুদ্ধে পথে নামার প্রয়োজনীয়তা পড়ুয়াদের বুঝিয়েছেন শিক্ষকেরাই। তাঁরাই ব্যানার, প্ল্যাকার্ড তৈরি করে দিয়েছেন। মিছিলে পড়ুয়ার পাশে হেঁটেছেন দায়িত্ববান অভিভাবকের মতো। বড়জোড়ার এক দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী বলে, ‘‘আর জি করের ঘটনার পরে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। তখন শিক্ষক-শিক্ষিকারাই সাহস জুগিয়েছেন। নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছেন।’’
বিষ্ণুপুর মহকুমার একটি স্কুলের অভিভাবক শ্যামল মণ্ডল বলেন, ‘‘শিক্ষকরাই সমাজ গড়ার কারিগর। তাঁরাই প্রতিবাদের ভাষা শেখাবেন, এটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন ফতোয়া এড়িয়ে কখনও পিছন থেকে আবার কখনও সামনে থেকে প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বহু শিক্ষক। এই ভূমিকাতেই আমরা শিক্ষকদের চাই।’’
শিক্ষক নিয়োগে বেনিয়মের অভিযোগ সামনে আসার পরেই শিক্ষকদের প্রতি অভিভাবক ও ছাত্র সমাজের একাংশের মানসিক দূরত্ব তৈরি হতে দেখা গিয়েছিল। শিক্ষকদেরই একাংশ জানাচ্ছেন, যেভাবে ‘ভুয়ো শিক্ষক’ নিয়োগের ঘটনা সামনে এসেছে, তারপরে অভিভাবক মহলে শিক্ষকদের প্রতি একটা প্রশ্ন তৈরি হচ্ছিল। পেশাগত সম্মানটা কোথাও ধাক্কা খেয়েছিল। তবে আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে শিক্ষক সমাজের আগুয়ান ভূমিকা অভিভাবকদের সঙ্গে তাঁদের মানসিক দূরত্ব কমিয়ে আনছে। শিক্ষকেরা যেন ফিকে হয়ে যাওয়া সেই সম্মান ফিরে পাচ্ছেন। রঘুনাথপুরের এক অভিভাবক প্রকাশ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি সামনে আসার পরে অনেকেরই মনে শিক্ষকদের প্রতি একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। কিন্তু আর জি কর কাণ্ডকে ঘিরে সামাজিক আন্দোলনে শিক্ষকদের অগ্রণী ও যথাযথ ভূমিকা দেখার পরে শিক্ষকদের প্রতি পুরনো আস্থা ফিরে এসেছে।’’
এবিটিএ-এর পুরুলিয়ার নেতা তথা রঘুনাথপুর ২ ব্লকের নীলডি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রণবকুমার নিয়োগীর দাবি, ‘‘শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছিল রাজ্য সরকারের শিক্ষা দফতরের মদতেই। কিন্তু তারপরেও শিক্ষকদের প্রতি সামাজিক সম্মান, শ্রদ্ধাবোধটা কিছুটা হলেও হারাচ্ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক আন্দোলনে শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা প্রত্যক্ষ করার পরে সেই শ্রদ্ধার জায়গাটা আবার ফিরে এসেছে।” তবে নিয়োগ দুর্নীতির জন্য শিক্ষক সমাজের কোনও অসম্মান হয়েছে বলে মনে করেন না বাঁকুড়ার এবিটিএ-র জেলা সম্পাদক অস্মিতা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘‘নিয়োগ দুর্নীতির জন্য সরকারের সম্মান গিয়েছে, শিক্ষক সমাজের নয়। চিরকাল শিক্ষকেরাই ন্যায়ের জন্য লড়াই করেছেন। এখনও করছেন।’’
খাতড়ার এক অভিভাবকের মতে, ‘‘হীরক রাজার দেশে সিনেমায় উদয়ন পণ্ডিত তাঁর ছাত্রদের নিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন। যুগে যুগে উদয়ন পণ্ডিতেরাই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রতিবাদের বীজ বুনে দেন। ছাত্র-শিক্ষক এ সম্পর্ক অমলিন।’’