গ্রাম-ঘুরে ছাত্রদের হোমওয়ার্ক করান শিক্ষক

সন্তানদের পড়াশোনা মূলত স্কুল নির্ভর। পরিবারের কেউ পড়াশোনা দেখিয়ে দেবেন তো দুরের কথা, শাসন করারও কেউ নেই। স্কুলে বড় কোনও ছুটি থাকলে অনাভ্যাসে ওই পড়ুয়ারা অন্য ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

সাঁইথিয়া শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৮ ০৭:১৫
Share:

পাঠ: সাঁইথিয়ায় চলছে পড়াশোনা। নিজস্ব চিত্র

সংসার টানতে সকাল হলেই বাবা-মায়েরা বেরিয়ে যান কাজে। ফিরতে বেলা গড়িয়ে যায় তাঁদের। স্কুল না থাকলে বাবা-মা বেরিয়ে যেতেই খেলা শুরু হয় ছেলেমেয়েদের। স্কুল না থাকলে পড়াশোনার থেকে দূরেই থাকে তারা। ক্রমেই পাঠ্যক্রমে পিছিয়ে পড়ে।

Advertisement

সেই সমস্যা দূর করতে নতুন পথে এগোলেন সাঁইথিয়ার পারিসর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বাসুদেব সূত্রধর। সিউড়ির ভল্লা গ্রামের বাসিন্দা বাসুদেববাবু বছরখানেক আগে ওই স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন। প্রত্যন্ত এলাকার ওই স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন তিন জন। পড়ুয়া ১২৩ জন। গ্রামে ঘুটিংডাঙ্গাল, বেলডাঙ্গাল এবং উঠোনডোলা নামে তিনটি আদিবাসী অধ্যুষিত পাড়া রয়েছে। পড়ুয়াদের বেশির ভাগই ওই তিনটি পাড়ায় থাকে। সে সবে ৭৭টি পরিবারের বাস। তার মধ্যে ৭৪টি পরিবারের ছেলেমেয়েরা প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। অনেক অভিভাবকেরাই ইটভাটা, বালিঘাটের মতো জায়গায় দিনমজুরি করেন। সকালে বেরিয়ে বাড়ি ফেরেন সন্ধেয়। তাই তাঁদের সন্তানদের পড়াশোনা মূলত স্কুল নির্ভর। পরিবারের কেউ পড়াশোনা দেখিয়ে দেবেন তো দুরের কথা, শাসন করারও কেউ নেই। স্কুলে বড় কোনও ছুটি থাকলে অনাভ্যাসে ওই পড়ুয়ারা অন্য ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে।

গরমের ছুটির পরে এখন তেমনই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি। গরমের ছুটির পরেও অতিরিক্ত ১০ দিন ছুটি ঘোষণা করেছে রাজ্য। লম্বা ওই ছুটিতে আদিবাসী পাড়ার ওই পড়ুয়ারা যাতে পড়াশোনায় পিছিয়ে না পড়ে সে জন্যই পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে তাদের পড়ানো শুরু করেছেন বাসুদেববাবু।

Advertisement

অন্য শিক্ষকদের মতো তিনি নির্ধারিত সময়েই স্কুলে পৌঁছন। তার পরে বেলা পৌনে ১১ নাগাদ বেরিয়ে পড়েন। এক দিন একটি পাড়ায়। গাছের তলা বা বাঁশের মাচানে ছেলেমেয়েদের পড়ান তিনি। ডেকে নেন পাশের পাড়ার ছেলেমেয়েদেরও। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত চলে পাঠদান।

‘স্যার’কে গ্রামে পেয়ে পড়ুয়ারাও খুশি। তৃতীয় শ্রেণির মঙ্গলি হাঁসদা, দ্বিতীয় শ্রেণির অভিজিৎ মাড্ডি, সুনিরাম মুর্মূ বলে— ‘‘স্যারকে কাছে পেয়ে এ বার আমাদের ছুটির হোমওয়ার্ক হয়ে গিয়েছে। বাড়িতে কেউ দেখিয়ে দেওয়ার নেই বলে কোনও বার হোমওয়ার্ক করতে পারিন না। স্কুলে বকা খেতে হয়। এ বার আর তেমন হবে না।’’

রবি কিসকু, বুধি হাঁসদার মতো অভিভাবকেরা বলেন— ‘‘কোনও শিক্ষক এ ভাবে বিনা বেতনে পাড়ায় এসে ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে যাবেন ভাবতে পারিনি।’’

বাবা, মা আর ভাইকে নিয়ে সংসার বছর তেত্রিশের বাসুদেববাবুর। বাবা-মা প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোননি। বাবা এক সময়ে ছুতোরের কাজ করতেন। অভাবের সঙ্গে লড়াই করেই লেখাপড়া করেছেন বাসুদেববাবু। সে সব দিন আজও ভোলেননি।

তিনি বলেন, ‘‘বাড়িতে পড়াশোনা বুঝিয়ে দেওয়ার কেউ না থাকলে কত সমস্যা হয় তা জানি। বিকেলের দিকে প্রতি দিনই ওই পাড়ায় যেতাম। গল্প বা খেলার ছলে ছাত্রছাত্রীদের যতটা সম্ভব পড়াশোনায় সাহায্য করতাম। এ বার থেকে স্কুলে বড় ছুটি পড়লেই পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’

স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নীরদবরণ সাহা জানান, বাসুদেববাবু স্কুলের পঠনপাঠনের মানোন্নয়নে নানা রকম উদ্যোগ নেন। সে জন্য স্কুলছুটের প্রবণতাও কমছে।

সাঁইথিয়া চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক সৌগত ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘অনুকরণযোগ্য উদ্যোগ। বাসুদেববাবু এক জন ছাত্রদরদী শিক্ষক। স্কুলছুট রুখতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রশংসনীয় ভুমিকা পালন করে চলেছেন।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement